রং বদলের স্বপ্ন দেখত আমার বন্ধু

কী ভাবে ব্যাখ্যা করব আমার বন্ধু রোহিত ভেমুলাকে! তার্কিক। যুক্তিবাদী। স্পষ্টবক্তা। নাকি খুব নরম মনের একটি ছেলে? তথাকথিত অন্তজ সমাজের প্রতিনিধি। স্বপ্ন দেখত সাম্যের। আশা ছিল এ দেশে সমাজ পরিবর্তন হবে বিজ্ঞানের হাত ধরে।

Advertisement

দীপক (নাম পরিবর্তিত) রোহিতের সহপাঠী

শেষ আপডেট: ২০ জানুয়ারি ২০১৬ ০৩:৩৩
Share:

সমকামীদের অধিকার দাবি করে মিছিলে রোহিত।

কী ভাবে ব্যাখ্যা করব আমার বন্ধু রোহিত ভেমুলাকে! তার্কিক। যুক্তিবাদী। স্পষ্টবক্তা। নাকি খুব নরম মনের একটি ছেলে? তথাকথিত অন্তজ সমাজের প্রতিনিধি। স্বপ্ন দেখত সাম্যের। আশা ছিল এ দেশে সমাজ পরিবর্তন হবে বিজ্ঞানের হাত ধরে। তাই বিজ্ঞানকেই পিএইচডি-র বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছিল রোহিত। সেই সূত্রেই আমার সঙ্গে ওর আলাপ। আমরা একসঙ্গে বিজ্ঞান বিভাগে গবেষণা করতাম। আমি ২০১১ সালে পিএইচডি করতে কলকাতা ছেড়ে পাড়ি দিয়েছিলাম দক্ষিণের হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে। দু’বছর পরে সেখানে যোগ দেয় রোহিত।

Advertisement

প্রথমে ভাবতাম মুখচোরা। কথা কম বলত। খালি বই মুখে দিয়ে বসে থাকত। বুঁদ হয়ে থাকত নিজের খেয়ালে। কার্তিক বিট্টু নামে এক বন্ধুর মাধ্যমে আমার সঙ্গে ওর আলাপ। মেশার পরেই রোহিত সম্পর্কে ধারণা পাল্টাতে শুরু করে। বুঝলাম মুখচোরা হলেও, কী ভীষণ যুক্তিবাদী ওর মন! শুধু দেশ নয়, পৃথিবীর পীড়িত মানুষদের জন্য কী বুক উজাড় করা ভালবাসা ছিল ওর। এখনও মনে আছে, দাদরিতে সন্দেহের বশে পিটিয়ে মারা হল আখলাককে। খবরটা শোনার পরে চোখে জল রোহিতের। গুম হয়ে গেল ছেলেটা। প্রশ্ন করলেই বলে, ‘‘আখলাক আমারই তো ভাই। তাঁকে এ ভাবে মেরে ফেলা হল!’’


উপাচার্যকে লেখা তাঁর চিঠির অংশ।

Advertisement

আসলে জাতি, বর্ণ, ধর্ম, দেশ কিছুই মানত না রোহিত। সমস্ত শ্রেণিবিভাজন মুছে দিতে চেয়েছিল সে। গুন্টুরের এক গণ্ডগ্রামে দলিত পরিবারে বড় হয়ে ওঠার অভিজ্ঞতা হয়তো পরবর্তী জীবনে তাকে ব্রাহ্মণ্যবাদ বা মনুবাদের ঘোরতর বিরোধী করে তুলছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে তাই উচ্চবর্ণের প্রাধান্য মেনে নিতে পারেনি সে। যোগ দেয় অম্বেডকর স্টুডেন্টস ইউনিয়নে। পছন্দ করত না সঙ্ঘ পরিবার বা বিজেপির মতাদর্শও। তাই মোদী সরকারের বিরুদ্ধে যেখানে যখন আওয়াজ উঠেছে, তা সে পুণে ফিল্ম ইন্সটিটিউট বা দাদরি যেখানেই হোক না কেন, সব ক্ষেত্রেই আগ বাড়িয়ে আন্দোলনে নামতে দেখেছি রোহিতকে। আমি সমকামী। সমকামী আন্দোলনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা সময়ে সভা, ওয়ার্কশপ করেছি। একাধিকবার অসুবিধায় পড়তে হয়েছে। কিন্তু যে কোনও সমস্যায় সব থেকে আগে পাশে পেয়েছি আমার বন্ধু তথা জুনিয়র রোহিতকে।

রং বদলের স্বপ্ন দেখা ছেলেটা গত বছর থেকেই কেমন যেন ম্রিয়মাণ হয়ে যেতে শুরু করেছিল। বুঝতে পারছিলাম, ধীরে ধীরে হতাশা গ্রাস করছে ওকে। চারপাশে এত অন্যায়, এত অবিচার— এ সবের বিরুদ্ধে যে ও কিছুই করতে পারছে না, এই বোধটাই কুরে কুরে খেতে শুরু করেছিল রোহিতকে। মাসখানেক আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে একটি চিঠি লেখে রোহিত। সেখানে ও লিখেছিল, ‘‘দলিত পড়ুয়াদের হয় বিষ, না হয় একটা দড়ি দিন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে দলিত পড়ুয়াদের অবস্থা এতটাই ভয়াবহ যে, কর্তৃপক্ষেরই স্বেচ্ছামৃত্যুতে সাহায্য করা উচিত!’’

তারপরে এল সাসপেনশনের নোটিস। কিন্তু প্রমাণ না পাওয়ায় ছাড়া পেয়ে গেল রোহিত ও বন্ধুরা। কিন্তু দ্বিতীয় বারের ধাক্কাটা সামলানো বেশ কঠিন ছিল। বন্ধ করে দেওয়া হয় ওর স্কলারশিপের ২৫ হাজার টাকাও। টাকা-পয়সার টানাটানি ছিলই। তা ছাড়া, বাইরে ভাড়া দিয়ে থাকার সঙ্গতি ছিল না রোহিতের। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরেই তাঁবু খাটিয়ে থাকছিল ওরা ক’জন। তাও ভেঙে দিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। শেষ ধাক্কাটা আর নিতে পারেনি। চরম অনিশ্চয়তা, হতাশা, জীবনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে আমার স্বপ্ন দেখা বন্ধুটি।

আজ রোহিতের মৃত্যু নিয়ে এত প্রতিবাদ, এত আন্দোলন দেখে মনে হচ্ছে, বেঁচে থেকে যে সমাজ পরিবর্তনের চেষ্টা করছিল আমার বন্ধু, মরে গিয়েও একই কাজে ব্রতী রয়েছে সে। একাই।

ছবি: লেখকের সৌজন্যে

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন