উপত্যকায় ভোটের অঙ্কে কৌশলী চাল মোদীর

পাকিস্তানের সঙ্গে বিদেশসচিব পর্যায়ের বৈঠক বাতিল হওয়ায় অনেকেই শান্তি প্রক্রিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন হলেও দিল্লি কিন্তু নিজেদের অবস্থানেই অনড়। অনেকেই বলছেন, এই পদক্ষেপের পিছনে একটি কারণ যদি হয় কাশ্মীর এবং সীমান্তপার সন্ত্রাস নিয়ে নিজেদের কঠোর অবস্থান স্পষ্ট করে দেওয়া, তা হলে অন্যটি হল উপত্যকায় বিধানসভা নির্বাচন।

Advertisement

জয়ন্ত ঘোষাল

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২০ অগস্ট ২০১৪ ০৩:২৩
Share:

পাক দূতাবাসে সৈয়দ আলি শাহ গিলানি। মঙ্গলবার নয়াদিল্লিতে এএফপির ছবি।

পাকিস্তানের সঙ্গে বিদেশসচিব পর্যায়ের বৈঠক বাতিল হওয়ায় অনেকেই শান্তি প্রক্রিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন হলেও দিল্লি কিন্তু নিজেদের অবস্থানেই অনড়। অনেকেই বলছেন, এই পদক্ষেপের পিছনে একটি কারণ যদি হয় কাশ্মীর এবং সীমান্তপার সন্ত্রাস নিয়ে নিজেদের কঠোর অবস্থান স্পষ্ট করে দেওয়া, তা হলে অন্যটি হল উপত্যকায় বিধানসভা নির্বাচন।

Advertisement

নভেম্বরে জম্মু-কাশ্মীরে বিধানসভা ভোট। সেই পর্ব শেষ না হওয়া পর্যন্ত পাকিস্তান সম্পর্কে কোনও রকম নরম মনোভাব নিতে নারাজ প্রধানমন্ত্রী। সে কারণেই কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাদের সঙ্গে পাক হাইকমিশনারের বৈঠকের পরেই ইসলামাবাদের সঙ্গে বিদেশসচিব পর্যায়ের বৈঠক বাতিলের কথা ঘোষণা করেছে দিল্লি। তার মানে আবার এই নয় যে, পাকিস্তানের সঙ্গে মোদী যে শান্তির উদ্যোগ নিয়েছেন, তা থেকে তিনি সরে আসছেন। কিন্তু তাঁকে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মাথায় রাখতে হচ্ছে। এক দিকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা যার ফলে প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ গদিতে টিকে থাকবেন কি না, তা নিয়েই সংশয় তৈরি হয়েছে। বিষয়টির দিকে নজর রাখছে দিল্লি। তা ছাড়া, আজও যে ভাবে কট্টরপন্থী হুরিয়ত নেতা সৈয়দ আলি শাহ গিলানির সঙ্গে পাক হাইকমিশনার আব্দুল বাসিত বৈঠক করেছেন, তাতে অন্য গন্ধ পাচ্ছে দিল্লি। অন্য দিকে সঙ্ঘ পরিবারের সঙ্গে বৈঠকে বিজেপি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কাশ্মীরে তাদের সমর্থনে একটি সরকার গড়ার জন্য সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপাতে হবে। বিজেপি সূত্র বলছে, এ কাজে সফল হওয়ার জন্য কড়া পাক-বিরোধী মনোভাব খুব জরুরি।

আর এই দুয়ের যোগফলেই ইসলামাবাদ সম্পর্কে আপাতত কঠোর হয়েছে দিল্লি। বিজেপি সূত্রে জানা গিয়েছে, বিধানসভা ভোটে হুরিয়তপন্থী নেতা প্রয়াত আব্দুল গনি লোনের পুত্র তথা পিপলস্ কনফারেন্সের চেয়ারম্যান সাজ্জাদ গনি লোনকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তুলে ধরে সরকার গঠনের চেষ্টা চালাবে দল। দলের তরফে কাশ্মীরের ভারপ্রাপ্ত বিজেপির সাধারণ সম্পাদক জে পি নাড্ডা সম্প্রতি সাজ্জাদ লোনের সঙ্গে তিনটি বৈঠক করেছেন। সাজ্জাদকে সামনে রেখেই বিজেপি যে এগোতে চাইছে, তার পিছনে কয়েকটি সুনির্দিষ্ট কারণ রয়েছে। তার অন্যতম হল, পাকিস্তান সম্পর্কে সাজ্জাদের নেতিবাচক মনোভাব। আব্দুল গনি লোনের মৃত্যুর পর সাজ্জাদ প্রকাশ্যে অভিযোগ করেন, তাঁর বাবাকে হত্যা করেছে আইএসআই। সাজ্জাদের এই মন্তব্য ঘিরে সে সময়ে তুমুল হইচই বেধে যায়। সাজ্জাদের মা ছেলেকে বিবৃতি প্রত্যাহার করতে বললেও তিনি কান দেননি। উপত্যকার সাম্প্রতিক সমীকরণ অনুযায়ী, সাজ্জাদ এখন বিজেপি সম্পর্কে যথেষ্ট নরম। এই সুযোগটাই নিতে চান বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ-সহ বহু বিজেপি নেতা।

Advertisement

পাক হাইকমিশনারের সঙ্গে সাক্ষাতের পর জম্মু-কাশ্মীর লিবারেশন
ফ্রন্টের প্রধান ইয়াসিন মালিক। নয়াদিল্লিতে। ছবি: পিটিআই

জম্মু-কাশ্মীর বিধানসভার আসন সংখ্যা ৮৭। এক সময় রাজ্য বিধানসভার আসনসংখ্যা ১০০টি ছিল। কিন্তু বাকি আসনগুলি পাক অধিকৃত কাশ্মীরে রয়ে যাওয়ায় এখন সেগুলিকে স্থায়ী ভাবে খালি রেখেই নির্বাচন পর্ব সারা হয়। এই ৮৭টি আসনের মধ্যে জম্মুতে রয়েছে ৩৭টি। যার মধ্যে ২৭টিতে হিন্দু ভোটারদের প্রাধান্য। সম্প্রতি রাম মাধব, রামলালের মতো আরএসএস নেতাদের উপস্থিতিতে একটি বৈঠক করেছেন অমিত শাহ। সেখানে ঠিক হয়েছে, উত্তরপ্রদেশে যে ভাবে মেরুকরণের রাজনীতি করে দল সাফল্য পেয়েছে, সে ভাবেই এ বার জম্মুতেও কট্টরবাদী পথ নেবে বিজেপি। তাতে একাধিক আসনে জয়ের সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করছেন বিজেপি নেতারা। বৈঠকে জম্মু-কাশ্মীরের জন্য ১৫ দফা কর্মসূচি নিয়েছে বিজেপি। যার অন্যতম কাশ্মীরি পণ্ডিতদের পুনর্বাসন ও অর্থ সাহায্যের ঘোষণা।

বিজেপির অঙ্ক কী? দলের বক্তব্য, উপত্যকায় ভোটারদের যা বিন্যাস তাতে একক ভাবে ক্ষমতা দখল কঠিন। তাই কয়েকটি হুরিয়ত গোষ্ঠীকে সঙ্গে নিয়ে এমন একটা জোট গড়া, যাতে বিজেপিই নির্ধারক হবে। এই অঙ্কেই কাশ্মীরের মন পেতে গত দু’মাসে দু’বার সেখানে গিয়েছেন মোদী। কার্গিলে গিয়ে তিনি পাকিস্তান সম্পর্কে আক্রমণাত্মক পথ নিয়েছেন। আবার লাদাখে গিয়ে স্থানীয় পোশাক পরে বৌদ্ধদের মন পেতে চেয়েছেন। কাশ্মীরের ভোটকে সামনে রেখে বিজেপি যে ভাবে মেরুকরণ করছে, তাতে ন্যাশনাল কনফারেন্স নেতা ওমর আবদুল্লা, পিডিপি নেত্রী মেহবুবা মুফতি, হুরিয়ত নেতা সৈয়দ আলি শাহ গিলানি-সহ অনেকে ক্ষুব্ধ।

বিজেপির এই কর্মকাণ্ডের দিকে সতর্ক নজর রাখছে পাকিস্তান। কিন্তু শরিফ নিজেও খুব স্বস্তিতে নেই। তাঁকে গদিচ্যুত করতে গত ক’দিন ধরে তুমুল আন্দোলন শুরু করেছেন ইমরান খান। অনেকেরই ধারণা, ইমরানকে মদত দিচ্ছে পাক সেনা, আইএসআই ও মোল্লাতন্ত্র। গদিতে টিকে থাকতে নওয়াজও কট্টরপন্থীদের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন। সংঘর্ষবিরতি লঙ্ঘন যার অঙ্গ বলেই মত অনেকের। হুরিয়ত নেতাদের বৈঠকের পিছনেও কট্টরপন্থী হাত রয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।

ইসলামাবাদ অবশ্য বলছে, অতীতেও হুরিয়ত নেতারা একাধিক বার পাক হাই কমিশনারের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। তাতে ভারত রসাতলে যায়নি। আজ গিলানিরাও কার্যত একই সুরে বিদেশসচিব পর্যায়ের বৈঠক বাতিল ঘিরে দিল্লিকে বিঁধেছেন।

বিজেপির এক শীর্ষ নেতা আজ বলেন, “জম্মুতে কংগ্রেসও কিন্তু পাকিস্তান বিরোধী কট্টর লাইন নিচ্ছে।” জম্মুতে কংগ্রেসের এই কৌশলে বেশ অস্বস্তিতে বিজেপি। তাই মোদীও পাল্টা চালে নরম-গরমের রাজনীতির পথ নিয়েছেন। যার স্বল্পমেয়াদি লক্ষ্য, উপত্যকায় ভোট আর পাক পরিস্থিতির উপর নজর রাখা। ভোট মিটলে শান্তি প্রক্রিয়া নিয়ে এগোনোর চেষ্টা হবে।

এখন দেখার নিউ ইয়র্কে সেপ্টেম্বরে শরিফ-মোদী সাক্ষাৎ হয় কি না। কূটনীতিকেরা চান, আপাতত যা-ই হোক, দু’জনের বৈঠকটি যেন হয়।

এগোচ্ছে ইমরানের মিছিল

নওয়াজ শরিফের ইস্তফার দাবিতে কয়েক হাজার সমর্থকের মিছিল নিয়ে মঙ্গলবার গভীর রাতে ইসলামাবাদের ‘রেড জোন’-এ ঢুকে পড়েছেন ইমরান খান। রেড জোনেই রয়েছে পার্লামেন্ট, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন, বিভিন্ন দূতাবাস। সংবাদ সংস্থা পিটিআইয়ের খবর, ইমরানের সঙ্গে আছেন ধর্মীয় নেতা তাহিরুল কাদরি। রেড জোনের সুরক্ষায় রয়েছে সেনা। তবে ইমরান জানান, তাঁরা শুধু পার্লামেন্টের সামনে ধর্নায় বসবেন। সরকারও জানিয়েছে, নিরাপত্তা বাহিনী যথাসম্ভব সংযত থাকবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন