নির্ভয়া তথ্যচিত্র

বারবার কেন সক্রিয় সরকার, উঠছে প্রশ্ন

তখন ইউপিএ জমানা। ড্যান ব্রাউনের উপন্যাস ‘দ্য দা ভিঞ্চি কোড’ অবলম্বনে তৈরি ছবি ঘিরে শুরু হয়েছে বিতর্ক। ছবিটি নিয়ে রোমান ক্যাথলিক চার্চের তরফে আপত্তি উঠেছে। ঠিক সেই সময় ছবিটি নিজে দেখার সিদ্ধান্ত নিলেন তৎকালীন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি। ‘দ্য দা ভিঞ্চি কোড’ ছাড়পত্র পেল ঠিকই। কিন্তু সেন্সর বোর্ড থাকতে কেন্দ্রীয় সরকার কেন নাক গলাবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠে গেল।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০১৫ ০২:৪৯
Share:

তখন ইউপিএ জমানা।

Advertisement

ড্যান ব্রাউনের উপন্যাস ‘দ্য দা ভিঞ্চি কোড’ অবলম্বনে তৈরি ছবি ঘিরে শুরু হয়েছে বিতর্ক। ছবিটি নিয়ে রোমান ক্যাথলিক চার্চের তরফে আপত্তি উঠেছে। ঠিক সেই সময় ছবিটি নিজে দেখার সিদ্ধান্ত নিলেন তৎকালীন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি। ‘দ্য দা ভিঞ্চি কোড’ ছাড়পত্র পেল ঠিকই। কিন্তু সেন্সর বোর্ড থাকতে কেন্দ্রীয় সরকার কেন নাক গলাবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠে গেল।

‘ফায়ার’, ‘রং দে বসন্তী’ থেকে শুরু করে ‘দ্য দা ভিঞ্চি কোড’। আর হাল আমলে নির্ভয়াকে নিয়ে তথ্যচিত্র ‘ইন্ডিয়াজ ডটার’। নরেন্দ্র মোদী সরকার এ দেশে তথ্যচিত্রটির প্রদর্শন নিষিদ্ধ করে দেওয়ার পর নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে, কে কোন চলচ্চিত্র বা তথ্যচিত্র দেখবেন বা দেখবেন না, সে বিষয়ে সরকার নাক গলাবে কেন?

Advertisement

বিষয়টি নিয়ে কংগ্রেসের অনেক নেতাই সমালোচনায় সরব হয়েছেন। কিন্তু ইতিহাস বলছে, কংগ্রেস জমানাতেও একাধিক বার বিভিন্ন ছবি প্রদর্শনের ক্ষেত্রে নাক গলিয়েছে সরকার। যেমন, সেন্সর বোর্ড ছাড়পত্র দেওয়ার পরেও ইউপিএ-জমানার তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী নিজে ছবি দেখে ঠিক করেছেন, তাকে ছাড়পত্র দেওয়া হবে কি হবে না।

‘দ্য দা ভিঞ্চি কোড’-এর মতো ‘রং দে বসন্তী’ নিয়েও একই বিতর্ক হয়েছিল। ছবিতে মিগ বিমান দুর্ঘটনায় তরুণ পাইলটদের প্রাণহানির বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছিল। সে সময় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। তিনি নিজে সামরিক বাহিনীর প্রধানদের নিয়ে ছবিটি দেখতে গিয়েছিলেন। আমির খান অভিনীত ‘ফনা’ও এক সময় নিষিদ্ধ হয়েছিল গুজরাতে। কারণ? আমির নর্মদায় বাঁধ দেওয়ার বিরুদ্ধে মুখ খুলেছিলেন। এর আগে দীপা মেটার ‘ফায়ার’-এর উপর নিষেধাজ্ঞা দাবি করেছে শিবসেনা। হালফিলে আমিরের ‘পিকে’ নিয়েও গোলমাল হয়েছে। কিছু রাজ্যে এই সব ছবি প্রদর্শনে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে।

কিন্তু তথ্য-প্রযুক্তি ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটার পরে কোনও ছবি বা তথ্যচিত্র নিষিদ্ধ করা কতটা বাস্তবসম্মত, তা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। নির্ভয়া-তথ্যচিত্র দেখানো বন্ধ করার পরেও এ দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ ইউটিউবে সেটি দেখে ফেলেছেন। তাই এত কিছুর পরে সরকারি নিষেধাজ্ঞা কতটা যুক্তিযুক্ত, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই।

জানুয়ারিতে ঠিক এই কথাটিই বলেছিলেন অরুণ জেটলি। যিনি মোদী সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রীও বটে। নির্ভয়া-কাণ্ডের পরে নারী নিগ্রহের বিরুদ্ধে আইন কঠোর করতে বিচারপতি জে এস বর্মার নেতৃত্বে কমিটি তৈরি হয়েছিল। সেই জে এস বর্মার স্মৃতিতেই প্রথম স্মারক বক্তৃতায় জেটলি বলেছিলেন, “আগে আমরা ভাবতাম কোনও সংবাদপত্র বা চ্যানেল নিষিদ্ধ করা যায়। কিন্তু এখন তো নিষিদ্ধ করার দিন অতীত। প্রযুক্তির দৌলতে সেন্সর এখন অসম্ভব। কোনও সরকারের পক্ষেই তা করা সম্ভব নয়। যদি জরুরি অবস্থা জারি হয়, তা হলেও সেন্সর করে কোনও লাভ হবে না।”

তা হলে জেটলির সরকারই কেন এই তথ্যচিত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করল? কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহের যুক্তি, তথ্যচিত্র তৈরির সময় পরিচালক লেসলি উডউইন আইন মানেননি। কিন্তু অনেকের মতে, আসলে ২০১২-র ডিসেম্বরে সেই গণধর্ষণের পর রাজধানীতে যে ধরনের প্রতিবাদ শুরু হয়েছিল, তথ্যচিত্রটি সবাই দেখলে তা ফের শুরু হতে পারে বলে আশঙ্কা করছিল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীন দিল্লি পুলিশও আইন-শৃঙ্খলার সমস্যার কথা বলেই নিষেধাজ্ঞার সমর্থনে মুখ খোলে।

তথ্যচিত্রে অন্যতম অপরাধী মুকেশ সিংহ নির্যাতিতার উপরেই দোষ চাপিয়েছে। অভিযুক্তদের দুই আইনজীবী এম এল শর্মা এবং এ পি সিংহর মুখেও একই সুর শোনা গিয়েছে। তাঁরাও ধর্ষণের জন্য নির্যাতিতাকেই দায়ী করেছেন। বার কাউন্সিল কাল গভীর রাতে তাঁদের শো-কজও করে। কিন্তু অনেকেই মনে করছেন, এই সব করে কেন্দ্র আসলে ভাবমূর্তি রক্ষার চেষ্টা করেছে। গীতিকার ও রাজ্যসভার সাংসদ জাভেদ আখতারের যুক্তি, “কোনও কারণই নিষেধাজ্ঞার জন্য যথেষ্ট নয়। পুরোটাই ভণ্ডামি এবং স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ।” অভিনেতা কবীর বেদীর মত, “ওই তথ্যচিত্রের ফলে ভারতের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়নি। নিষেধাজ্ঞার ফলে দেশের ভাবমূর্তিতে ধাক্কা লেগেছে।” রাজ্যসভার সাংসদ অনু আগা বলেন, “বাস্তব হল, তথ্যচিত্রে ওরা যা বলেছে, ভারতে বহু পুরুষের সেটাই মত। আমরা তা কেন লুকোচ্ছি?” তাঁর যুক্তি, “নিষেধাজ্ঞা জারি সম্মানের নয়। এ দেশে অধিকাংশ পুরুষই মহিলাদের সম্মান করেন না। ধর্ষণ হলেই মহিলাদের উপর দোষ চাপিয়ে দেওয়া হয়। এই সত্যর মুখোমুখি হতে হবে। সব ঠিক আছে, এই ভণিতাটা এ বার ছাড়া উচিত।”

মজার বিষয়, জে এস বর্মা স্মারক বক্তৃতায় জেটলি বলেছিলেন, “যার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হবে, তা নিয়ে কৌতূহল আরও বাড়বে। সেটি আরও প্রচার পাবে।” তা হলে এখন কেন নিষেধাজ্ঞা? বিজেপির মুখপাত্র শাইনা এনসি-র যুক্তি, “বাক্ স্বাধীনতার সঙ্গে দায়িত্বও এসে বর্তায়। গবেষণার নাম করে তিহাড় জেলে মুকেশ সিংহর সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। তার পর তা তথ্যচিত্রে ব্যবহার করা হয়েছে। সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য নিষেধাজ্ঞার পক্ষেই মত দিয়েছেন।” কিন্তু বিজেপিরই সাংসদ পুনম মহাজনের মতে, “যাদের তথ্যচিত্রে দেখানো হয়েছে, তাদের মনোভাব বদলানোটা বেশি জরুরি।”

পরিচালক মহেশ ভট্টের মতে, গণতন্ত্র সব ধরনের মতামত ও তথ্যের উপর ভর করে এগোয়। ‘সাংস্কৃতিক অভিভাবকরা’ মাঝে মাঝে এমন ভাবে কোনও মত ধামাচাপা দিতে চেষ্টা করেন যার ফলে গণতন্ত্রের কাঠামোই ধাক্কা খায়। নির্ভয়া-তথ্যচিত্র দেখানো বন্ধ করতে গিয়েও সেটাই হয়েছে বলে মনে করেন মহেশ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন