হাতকড়ার সঙ্গে ১১ পুলিশ, এলেন ভৈরোঁ

রাজস্থানের মিরচি শেঠ অস্ত্র পাচার করত। তার গুদাম থেকে শুকনো লঙ্কার বস্তায় ভরে ভরে চালান হতো বন্দুক-বুলেট। তাকে পাকড়াও করতে জীবন বাজি রেখেছিলেন মুম্বই পুলিশের ক্রাইম ব্রাঞ্চের এসিপি অজয় রাঠৌর (আমির খান)।

Advertisement

সুনন্দ ঘোষ

মুম্বই শেষ আপডেট: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৪:০৩
Share:

মাদক-মাফিয়া ভৈরোঁ সিংহ

রাজস্থানের মিরচি শেঠ অস্ত্র পাচার করত।

Advertisement

তার গুদাম থেকে শুকনো লঙ্কার বস্তায় ভরে ভরে চালান হতো বন্দুক-বুলেট। তাকে পাকড়াও করতে জীবন বাজি রেখেছিলেন মুম্বই পুলিশের ক্রাইম ব্রাঞ্চের এসিপি অজয় রাঠৌর (আমির খান)। রাজস্থানের মরু প্রান্তরের ডেরায় হানা দিয়ে মিরচিকে তিনি জালে ফেলেন। মূল চক্রী, অর্থাৎ গজল গায়ক গুলফাম হাসানের (নাসিরুদ্দিন খান) আসল চেহারাও ফাঁস করে দেন।

এ ছিল রূপালি পর্দার টানটান থ্রিলার ছবি। বাস্তবেও মিরচি শেঠেরা রয়েছে। যেমন, রাজস্থানের ঝালোয়ার জেলার ভৈরোঁ সিংহ। মাঝে-মধ্যে হাতিয়ার পাচার করলেও তার মূল পুঁজি মাদক। হেরোইন। চাল-ডাল হোক বা যন্ত্রপাতি, রাজস্থান থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে লরিতে পাঠানো বিভিন্ন পণ্যের মধ্যে লুকিয়ে পাচার হয়ে যাচ্ছিল ভৈরোঁ সিংহের হেরোইন।

Advertisement

অভিযোগ: পুলিশ-প্রশাসনকে হাতের মুঠোয় পুরে ভৈরোঁ দিনের পর দিন কুকর্ম চালিয়ে এসেছে। এ বার তার পালে পুলিশ পড়েছে। রাজস্থান পুলিশেরই হাতে ভৈরোঁ ধরা পড়েছে, কলকাতার একটি মামলায় সূত্রে।

শনিবার সকালে ঝালোয়ারের বাড়ির কাছে ভৈরোঁকে গ্রেফতারের পরে পুলিশ কোনও ঝুঁকি নেয়নি। মাদক-মাফিয়ার ‘প্রবল প্রতিপত্তি’র কথা মাথায় রেখে সে দিনই তাকে কলকাতার ট্রেনে তুলে দেওয়া হয়। যাত্রাপথের পুরোটা তাকে ঘিরে ছিলেন স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রধারী ১১ জন পুলিশকর্মী ও অফিসার। ‘‘ওর টাকার জোর যেমন, তেমন নানা নেতার সঙ্গে দহরম-মহরম। দলবল যখন-তখন হামলা চালিয়ে ওকে ছাড়িয়ে নিয়ে যেতে পারত।’’— ফোনে বলেন ঝালোয়ারের এসপি রাজেন্দ্র সিংহ।

সোমবার হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে ভৈরোঁকে নারকোটিক কন্ট্রোল ব্যুরো (এনসিবি)-র হাতে সমর্পণ করে দেওয়া হয়। সোমবার রাতে তাকে বিধাননগরের নিউটাউন থানার লকআপে রাখা হয়েছিল। মঙ্গলবার বারাসত আদালতে পেশ করা হয়। বিচারকের নির্দেশে আপাতত ভৈরোঁ সিংহের ঠিকানা বারাসত জেল।

রাজস্থানের মাদক-চক্রে কলকাতার কী যোগ?

এনসিবি-সূত্রের খবর: ঘটনার সূত্রপাত দু’যুগ আগে। সল্টলেকে হেরোইন-সহ ধরা পড়া দুই দুষ্কৃতীর কাছে প্রথম ভৈরোঁ-সূত্রের হদিস মেলে। ২০০২-এর সেই অভিযানের বিবরণ দিতে গিয়ে ব্যুরোর পূর্বাঞ্চলীয় ডিরেক্টর সুব্রত বিশ্বাস জানান, গোপন সূত্রে খবর পেয়ে সল্টলেকের রাস্তায় এনসিবি অফিসারেরা ওত পেতে ছিলেন। একটি গাড়িকে ধরে সওয়ারি আনসার রহমানের কাছ থেকে সাড়ে তিন কেজি হেরোইন উদ্ধার হয়। আনসারকে জেরা করে সল্টলেকের এজে ব্লকের এক বাড়িতে পাওয়া যায় ৫০ কেজি হেরোইন। ধরা পড়ে দীপক গিরি নামে আর এক ব্যক্তি। আদতে নেপালি দীপকের বাড়ি উত্তরবঙ্গে।

আনসার অবশ্য কলকাতারই বাসিন্দা। এবং মাদক পাচারের পুরনো পাপী। এনসিবি-সূত্রের খবর: ১৯৮৭-তে আনসার কলকাতা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছিল, দু’কেজি হেরোইন ও ৪৭ কেজি চরস সমেত। সে বার তার দশ বছর জেল ও দু’লাখ টাকা জরিমানা হয়। ১৯৯৩-এ সাজার মেয়াদ শেষ হলে আনসার আবার জড়িয়ে পড়ে মাদক কারবারে। ২০০২-এ ফের জালে পড়া ইস্তক আনসার গারদেই। ‘‘আনসার, দীপক বারাসত জেলে বন্দি। মামলা চলছে।’’— বলেন সুব্রতবাবু। তিনি জানান, ওদের জেরা করে আরও দুই পাচারকারীকে গ্রেফতার করা হয়।

আনসার-দীপকের কথাবার্তায় মালুম হয়ে যায়, দেশ জোড়া মাদক-কারবারে ভৈরোঁ সিংহ অন্যতম হোতা। তার পাঠানো ‘মাল’ই ছড়িয়ে পড়ে দেশের কোণে কোণে। এনসিবি অফিসারেরা তখন রাজস্থানে গিয়ে ভৈরোঁর হদিস পাননি। বছর তিনেক বাদে জানা যায়, মুম্বই পুলিশের হাতে ধরা পড়ে ভৈরোঁ রয়েছে আর্থার রোড জেলে। এনসিবি সঙ্গে সঙ্গে মুম্বই পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে। তত দিনে বারাসত কোর্টে তার নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। ঠিক হয়, মুম্বইয়ের মামলায় জেল হেফাজত ফুরোলে ভৈরোঁকে কলকাতায় পাঠানো হবে। কিন্তু হয়নি। সুব্রতবাবু জানিয়েছেন, ২০১০-এ মুম্বইয়ের মামলায় ভৈরোঁ যখন খালাস পেল, মুম্বই পুলিশ তখন আর তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। ফলে ভৈরোঁ চলে যায় নাগালের বাইরে। নতুন গ্রেফতারি পরোয়ানা বার করে এনসিবি তখন থেকে তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল।

সন্ধানের অবসান হল শনিবার। যদিও ভৈরোঁকে কব্জায় পেতে পুলিশকে বিস্তর ঘাম ঝরাতে হয়েছে। এসপি’র কথায়, ‘‘ভৈরোঁ নামজাদা বাহুবলি। গ্রেফতারির খবর ছড়িয়ে পড়লে আইন-শৃঙ্খলায় সমস্যা হতে পারত। তাই তড়িঘড়ি স্থানীয় কোর্টে ট্রানজিট রিমান্ড নিয়ে ওকে কলকাতায় পাঠিয়ে দিয়েছি।’’

এনসিবি’র হাতে ভৈরোঁ সিংহকে ‘জমা করতে’ পেরে আক্ষরিক অর্থেরই হাঁফ ছেড়েছে রাজস্থান পুলিশ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন