ইন্দিরা গাঁধীর জন্মশতবর্ষ উদ্যাপনের সূচনায় সনিয়া। শনিবার। ছবি: প্রেম সিংহ।
কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকারের কোনও অনুষ্ঠান নয়। বরং জাতীয় কংগ্রেসের আয়োজনে এক বছর ধরে ইন্দিরা গাঁধীর জন্মশতবর্ষ উদযাপনের সূচনা। আর সেখানেই রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় মনে করিয়ে দিলেন, ইন্দিরা বিশ্বাস করতেন, ভোটে হেরে বিরোধী আসনে বসলেও কোনও দলের ভূমিকা বদলে যায় না। বিরোধী দলের দায়িত্বই হল, বিরোধিতা করা, সরকারের আসল চেহারা প্রকাশ্যে আনা এবং সম্ভব হলে সরকারকে গদিচ্যুত করা।
লোকসভা ভোটে মোদীর বিজয়রথের ধাক্কায় ৪৪টি আসনে নেমে আসা কংগ্রেসের নেতারা প্রণববাবুর এই বক্তব্যকে স্পষ্ট বার্তা হিসেবেই দেখছেন। যা হল, ইন্দিরা জরুরি অবস্থার ধাক্কা কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন। একই ভাবে সনিয়া-রাহুল গাঁধীর কংগ্রেসের পক্ষেও ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব। প্রণবের বক্তৃতায় চাঙ্গা কংগ্রেস নেতারা বলছেন, তাঁদের চাপে রাখতে বিজেপি প্রায়ই জরুরি অবস্থার প্রসঙ্গ তোলে। প্রণব সেই জরুরি অবস্থার ধাক্কা সামলে ইন্দিরার ঘুরে দাঁড়ানো থেকেই দলকে অনুপ্রেরণা নিতে বলেছেন।
ইন্দিরা-জন্মশতবর্ষকে সামনে রেখে মোদী সরকারের পাল্টা মত তুলে ধরার চেষ্টা করছে কংগ্রেস। সেই কারণেই আজ, ইন্দিরার ৯৯-তম জন্মদিবস থেকে এক বছর ব্যাপী অনুষ্ঠানের সূচনা করেছে তারা। মোদী সরকার তথা বিজেপি-আরএসএসের বিরুদ্ধে ধর্মীয় ভেদাভেদ, দলিত-সংখ্যালঘুর উপর অত্যাচারের অভিযোগ তুলে ধরার পাশাপাশি ইন্দিরা তথা দলের ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক মনোভাব তুলে ধরতে চাইছে কংগ্রেস। এই কৌশলের মোকাবিলায় মোদী সরকার আজ থেকে সাম্প্রদায়িক ঐক্য সপ্তাহ পালন শুরু করেছে। আজ সংসদে ইন্দিরার ছবিতে শ্রদ্ধা জানাতে সনিয়া-রাহুলের পাশাপাশি অরুণ জেটলির মতো শীর্ষ মন্ত্রী হাজির হয়েছিলেন। মোদী সরকার চাইছিল, সনিয়া গাঁধীকে সাম্প্রদায়িক ঐক্য সপ্তাহ পালনের অনুষ্ঠানে নিয়ে আসতে।
কিন্তু সেই ফাঁদে পা দেননি সনিয়া। তার বদলে ইন্দিরা জন্মশতবার্ষিকী বক্তৃতায় কংগ্রেসের মঞ্চে তিনি রাষ্ট্রপতিকে আমন্ত্রণ জানান। অনুষ্ঠানের শুরুতে মোদীর নাম না করে খোঁচা দিয়ে বলেন, ‘‘শর্টকাটে মহৎ হওয়ার জন্য আজ যখন নেতারা ভারতের জাতীয় চরিত্রের ভিতকেই গুরুত্ব দিচ্ছেন না, তখন বৈচিত্র্যের মধ্যেও ঐক্য ও বহুত্ববাদী ভারত ধরে রাখায় ইন্দিরার বলিদান মানুষ আরও বেশি করে মনে রাখবে।’’ ইন্দিরা সম্পর্কে বলতে গিয়ে সনিয়া বলেন, ‘‘আমি ওঁর থেকেই প্রথম রাজনীতির শিক্ষা নিই। আমাকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ উনিই শিখিয়েছিলেন।’’ তাঁর কোলে গুলিবিদ্ধ ইন্দিরার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের উল্লেখ করতে গিয়ে এত বছর পরেও কিছুটা বিহ্বল হয়ে পড়েন সনিয়া। তার পরেই প্রণববাবুর উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘‘এ দেশের খুব কম জীবিত রাষ্ট্রনেতাই ওনার মতো দাবি করতে পারেন যে, তিনি ইন্দিরার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে কাজ করেছেন। আমরা কৃতজ্ঞ, উনি আমাদের আমন্ত্রণে নিজের স্মৃতি ভাগ করে নিতে রাজি হয়েছেন।’’
অতীত ফিরে দেখা। ইন্দিরা গাঁধী সংগ্রহশালা ঘুরে দেখছেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। রয়েছেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের স্ত্রী গুরশরণ কৌর ও রাহুল গাঁধী। শনিবার নয়াদিল্লিতে।—নিজস্ব চিত্র
তাৎপর্যপূর্ণ হল, নিজের স্মৃতি থেকে জরুরি অবস্থার পরে ভোটে হারের ধাক্কা কাটিয়ে ইন্দিরার ঘুরে দাঁড়ানোর কথাই বেশি শুনিয়েছেন প্রণব। একেকটা ঘটনা তিনি বলেছেন, আর মঞ্চে বসা সনিয়া অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে রাহুলের দিকে তাকিয়েছেন।
প্রণব এ দিন মনে করিয়ে দিয়েছেন, জরুরি অবস্থার পরে ১৯৭৭-এর নির্বাচনে কংগ্রেস বিপুল ভাবে হেরে যায়। ইন্দিরা নিজেও হেরে যান রায়বরেলী থেকে। সেই প্রথম কংগ্রেসকে বিরোধী আসনে বসতে হয়। সেই ব্যর্থতার দায় পুরোটাই ইন্দিরা একা নিয়েছিলেন। কয়েক মাসের মধ্যেই ধাক্কা কাটিয়ে উঠে গোটা দেশে ঘুরতে শুরু করেন তিনি।
সেই সময় সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলেই ইন্দিরা জবাব দিতেন, ‘অপেক্ষা করুন, দেখুন, পরিস্থিতি পাল্টাতেও পারে।’ প্রণবের কথায়, ‘‘ইন্দিরার সবথেকে বড় শক্তি ছিল, সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে কংগ্রেসের নিচুতলার কর্মীদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ।’’
কংগ্রেস নেতারা মনে করেন, বিহারের বেলচিতে দলিত-হত্যার পরে ইন্দিরার পৌঁছে যাওয়া থেকেই কংগ্রেসের ঘুরে দাঁড়ানোর শুরু। সেই বেলচির ঘটনাও এ দিন শুনিয়েছেন প্রণব। তাঁর সেই ঘটনা শুনতে শুনতে ফের রাহুলের দিকে তাকান সনিয়া। কংগ্রেস নেতাদের ব্যাখ্যা, রাহুলকে বেলচির মতো ঘটনা থেকে শিক্ষা নেওয়ার ইঙ্গিতই করেছেন সনিয়া।
কংগ্রেস যখনই নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে একনায়কতন্ত্রের অভিযোগ তোলে, তখনই বিজেপি নেতারা পাল্টা জরুরি অবস্থার প্রসঙ্গ তোলেন। তা নিয়ে আজ কোনও মন্তব্য করেননি প্রণব। আর সনিয়া মনে করিয়ে দিয়েছেন, কেউ ইন্দিরাকে দুর্বল, কেউ অত্যাচারী বললেও তিনি মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ ছিলেন।