কথাটা শুনেই চটে লাল প্রৌঢ়— ‘‘বাজেট! সে তো দিল্লির ব্যাপার।’’
ঘটনাটা গত পরশুর। দয়ালবাগের সভাস্থলে আসতে অখিলেশ যাদব-রাহুল গাঁধীর দেরি দেখে চায়ের দোকানে এসেছিলেন খাদ্য দফতরের প্রাক্তন কর্মী নীরজ কুমার। কেন্দ্রীয় বাজেট উত্তরপ্রদেশের ভোটে প্রভাব ফেলবে কি না প্রশ্ন করতেই কিছুটা উত্তেজিত ৬৩ বছরের নীরজ। বললেন, ‘‘নোট বাতিলের চক্করে দু’মাস ধরে যা নাকানিচোবানি খেতে হয়েছে! নিজের টাকা তুলতে গেলে এত সমস্যা হবে, কে জানত!’’
আর বাজেট? ‘‘কাগজে পড়েছি আয়করে কিছু ছাড় দেওয়া হয়েছে। তার বেশি কিছু হয়েছে বলে শুনিনি।’’ গজগজ করতে করতে প্রৌঢ়ের স্বগতোক্তি, ‘‘এখনও আগরার সব এটিএমে টাকা এল না। এ দিকে ঘোষণার শেষ নেই!’’
চায়ের দোকানি থেকে হোটেল ম্যানেজার, ট্র্যাভেল এজেন্ট থেকে তাজ দর্শনে নিয়ে যাওয়া অটোওলা— সকলেরই সুর প্রায় এক। নোট বাতিলের চক্করে যে ধাক্কা তাঁরা খেয়েছিলেন, নতুন বছরের এক মাস কেটে যাওয়া পরেও তার প্রভাব কাটেনি। এবং অদূর ভবিষ্যতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার কোনও লক্ষণও দেখছেন না তাঁরা।
আগরা থেকে কানপুর যাওয়ার পথে এক কোণে জগন্নাথপুর গ্রাম। শীতের সকালে চারপাইয়ে বসে খবরের কাগজের পাতা ওল্টাচ্ছিলেন রাজকিরণ। কৃষক পরিবারের সন্তান। কিন্তু চাষ না করে বাসে হেল্পারি করতেন। নোট বাতিলের ধাক্কায় মালিক বাস বসিয়ে দিয়েছে। রাজকিরণও ‘বসে গিয়েছেন’ বাড়িতে। বাজেট, কর ছাড়, অনলাইন কেনাকাটা— এ সবই ভিন্গ্রহের ব্যাপার তাঁর কাছে। হাতের কাগজটা চারপাইয়ের এক কোণে ছুড়ে ফেলে দিয়ে বিড়ি ধরিয়ে ঠান্ডা গলায় রাজকিরণ বললেন, ‘‘এই গ্রাম গত বার ঢেলে ভোট দিয়েছিল মোদীকে। এ বার তার দশ ভাগও পাবে না বিজেপি।’’ নোট বাতিলে চাষিরা যেমন বীজ কিনতে সমস্যায় পড়েছেন, ঠিক তেমনই আগরা-কানপুরে একের পর এক ছোট কারখানা বন্ধ হওয়ায়
গ্রামে ফিরে আসতে হয়েছে রাজকিরণের মতো যুবকদের। ফলে ক্ষোভ বাড়ছে সর্বস্তরেই।
ঠিক এখানেই ভয় পাচ্ছে বিজেপি। ছ’মাস আগেও যেখানে উত্তরপ্রদেশের অলি-গলি, গাঁও-দেহাতে অখিলেশ বিরোধিতার হাওয়া বইছিল, আজ সেখানে চাঁদমারিতে প্রধানমন্ত্রী মোদী। বিজেপির এক কেন্দ্রীয় নেতার আক্ষেপ, ‘‘প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার যে হাওয়া ছিল, বাবা-ছেলের নাটকে তা ধুয়েমুছে সাফ। উল্টে সহানুভূতিই পাচ্ছেন অখিলেশ।’’ বিজেপি নেতাদের বড় অংশই ভেবেছিলেন, নোট বাতিলের ক্ষতে মলম দেবে জেটলির বাজেট। দেখা যাচ্ছে, সে গুড়েও বালি।
এই সুযোগে মানুষের ক্ষোভ উস্কে দিতে কার্পণ্য করছেন না অখিলেশ-রাহুল। মোদীর উদ্দেশে তাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন— যুব সম্প্রদায় বা কৃষকদের জন্য তিনি করেছেনটা কী? লড়াই কঠিনতর হচ্ছে বুঝে বিজেপির একাংশ এখন বলছে, দলের উচিত ছিল উত্তরপ্রদেশে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে কাউকে তুলে ধরা। যিনি রাজ্যবাসীকে অন্তত নতুন করে স্বপ্ন দেখাতে পারতেন। কিন্তু এখন বিরোধী আক্রমণ থেকে মানুষের অসন্তোষ— সবটাই মোদীকেন্দ্রিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। উত্তরপ্রদেশে বিজেপি তৃতীয় স্থানের জন্য লড়ছে কি না, সেই প্রশ্নও উঠছে!
এই আবহাওয়ায় কার্যত নিশ্চুপে ঘর গুছিয়ে চলেছেন বিএসপি নেত্রী মায়াবতী। দলিতরা তাঁর ভোটব্যাঙ্ক। নোট বাতিলের বিরুদ্ধে সরব হয়ে মায়াও নিয়মিত বার্তা দিয়ে গিয়েছেন প্রান্তিক মানুষদের। ২০০৭ সালে মায়া ক্ষমতায় ফিরেছিলেন ব্রাহ্মণ ভোটকে তুরুপের তাস করে। সেই প্রথম বার একই প্রার্থীকে ভোট দিয়েছিলেন দলিত ও ব্রাহ্মণেরা। মায়াবতীর থেকে মুখ ফেরানো ব্রাহ্মণেরাই এখন বিজেপির পাশে। তাই ‘বহেনজির’ বাজি সংখ্যালঘু ভোট। বসপা শিবিরের দাবি, একাধিক গোষ্ঠী সংঘর্ষের কারণে এমনিতেই মুসলিমরা সপা সরকারের উপর ক্ষিপ্ত ছিলেন। তা ছাড়া, বাবা মুলায়মের মতো কিন্তু এখনও সংখ্যালঘুদের ভরসার পাত্র হয়ে উঠতে পারেননি অখিলেশ। সে কারণেই রাজ্যের ৪০৩টি আসনের মধ্যে ১১০টিতে সংখ্যালঘু প্রার্থী দিয়েছেন মায়াবতী। অখিলেশ-জমানায় সপা থেকে বহিষ্কৃত কওমি একতা দলের নেতা মুখতার আনসারিকে ফিরিয়ে নিয়েছেন বিএসপিতে।
আগরার ছিপিটোলার কাছে বিএসপি দফতরে বসে ছিলেন দীনেশ-চান্দুরা। ল্যাপটপ খুলে পরিসংখ্যান দেখিয়ে বললেন, ‘‘২০১২ সালে মাত্র দু’থেকে আড়াই শতাংশ মুসলিম ভোট সপা’র দিকে ঝুঁকেছিল। তাই অখিলেশ মুখ্যমন্ত্রী হতে পেরেছিলেন। লোকসভায় মোদী ঝড়েও বিএসপি-র দলিত ভোট অটুট ছিল। এখন দু-তিন শতাংশ মুসলিম ভোট পাশে পেলেই হিসেব উল্টে দেব আমরা।’’