সুকুমার রায় বলতেই পারেন, ছুটলে কথা থামায় কে? আজকে আমায় ঠেকায় কে? কিন্তু প্রকাশ কারাট ঠেকাতে চান!
কথার প্যাঁচেই বেঁচে থাকেন রাজনীতিকেরা। কারাটেরাও ব্যতিক্রম নন মোটে। কিন্তু তাঁদের ধারণা হয়েছে, পলিটব্যুরোর নেতারা প্রকাশ্যেই বড্ড বেশি কথার প্যাঁচ দিচ্ছেন! তাতে বেফাঁস কথা বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে। তাই পলিটব্যুরোর সদস্যদের সিপিএম লিখিত পরামর্শ দিচ্ছে, তাঁরা বাজে বকা বন্ধ করুন! নইলে দলের খবর পাঁচ কান হয়ে যাচ্ছে!
এই হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুকের যুগেও সিপিএমের সন্দেহ হয়েছে, দলের শীর্ষ স্তর থেকে অন্দরের খবর বাইরে চলে যাচ্ছে। খবর ফাঁসের কিনারা করতে পলিটব্যুরোর সদস্য বি ভি রাঘবুলুকে দিয়ে তদন্ত করিয়ে ফেলেছে তারা। তাতে আবিষ্কার হয়েছে, ছক কষে কিছু নেতা ঘরের কথা বাইরে এনে দিচ্ছেন! অতএব, মুখে লাগাম দেওয়ার পরামর্শ। যা স্থান পেয়েছে এ বারের পার্টি কংগ্রেসের জন্য তৈরি সিপিএমের রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক রিপোর্টে।
বাংলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন প্রশাসনিক সভা থেকে দলের কোর কমিটির বৈঠক সবই টিভি ক্যামেরার সামনে করেন, সিপিএম আবার আলোচনা করে লৌহপর্দার আড়়ালে! এটাই তাদের দস্তুর। যা দেখে দলেরই কেউ কেউ বলেন, সিন্দুকে মোহর নেই কিন্তু চৌকিদার তাগড়়া! এ বারের দলীয় রিপোর্টে অবশ্য স্পষ্ট করে বলা হয়নি যে, কারা খবর ফাঁস করছেন। কিন্তু ঠারেঠোরে ইঙ্গিত সীতারাম ইয়েচুরির দিকে!
কী রকম? সাংগঠনিক রিপোর্টের ৩০-৩২ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে: ‘গত পার্টি কংগ্রেসের পর থেকে পার্টি লাইন নিয়ে মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে। সকলে একমত হননি, যাঁদের মধ্যে সাধারণ সম্পাদকও আছেন। এর ফলে পলিটব্যুরো সদস্যের সমন্বয় কমে গিয়েছে। যে রাজনৈতিক বা সাংগঠনিক প্রশ্নে দ্রুত হস্তক্ষেপ প্রয়োজন, তখন সেটা করা যায়নি’। রিপোর্টের এই বয়ানে ইঙ্গিত, ভিন্ন মত থাকায় বিতর্ক এবং বিতর্ক থেকেই খবর ফাঁস! যে কারণে রিপোর্টে হুঁশিয়ারি আছে, ‘পার্টি কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যদের গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার নীতি কঠোর ভাবে মেনে চলতে হবে। আলটপকা কথা চলবে না’! প্রসঙ্গত, দিল্লিতে পার্টি কেন্দ্রের সঙ্গে এখন যুক্ত পলিটব্যুরোর ৯ জন নেতা।
সাংসদ ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে দলীয় তদন্তের সময়ে খবর ফাঁস ধরতে বাংলার সিপিএমেও মদন ঘোষের নেতৃত্বে কমিশন হয়েছিল। কেউ নেতাদের বোঝাতেই পারেননি, উইকিলিক্স, ফেসবুকের তথ্য চুরির যুগে লৌহপর্দার আর কী অর্থ!
দলের ভিতরে ও বাইরে ইয়েচুরির বরাবরের যুক্তি, ভিন্ন মত এবং বিতর্ক তো জীবন্ত পার্টির লক্ষণ! কিন্তু সিপিএম কি আর তেমন সজীব আছে? হতে পারে, জীবনীশক্তি কমে আসার প্রহরে দাঁড়়িয়ে সুকুমারের মতোই কারাট হয়তো বলতে চান— যাওয়ার আগে বলব যা মোর চিত্তে লাগে/ নাই বা তাহার অর্থ হোক, নাই বা বুঝুক বেবাক লোক!