প্রোটোকল ভেঙে ভারতরত্ন-প্রাপকের বাড়িতেই পৌঁছে গেলেন রাষ্ট্রপতি। ছবি: রাষ্ট্রপতি ভবনের সৌজন্যে।
সাত বছর ধরে জনসভায় তাঁর মন্ত্রমুগ্ধ বক্তৃতার রস উপভোগ করেননি ভক্তকুল। পাঁচ বছর ধরে বাড়ির বাইরে পা রাখাও বন্ধ। আর তিন বছর হল, ছবিতেও এক পলকের জন্য দেখা হয়নি।
আজ হল। তা-ও রাষ্ট্রপতি ভবনের সৌজন্যে। রাজধানীর ৬ নম্বর কৃষ্ণ মেনন মার্গের বাংলোর উঁচু প্রাচীরটির ওপারে যখন পৌঁছে গেলেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। রাষ্ট্রপতি যখন দেশের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান ‘ভারতরত্ন’ তুলে দিলেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীকে। যে অনুষ্ঠান সাধারণত হয় রাষ্ট্রপতি ভবনেই।
তার কিছুক্ষণ পরেই রাষ্ট্রপতি ভবনের পক্ষ থেকে জারি করা হল বাজপেয়ীর একটি ছবি। সেই মুহূর্তটির। যখন সর্বোচ্চ সম্মানটি তিনি পাচ্ছেন দেশের রাষ্ট্রপতির হাত থেকে। রাষ্ট্রপতির এডিসির হাতে ঢাকা পড়ে গিয়েছে বাজপেয়ীর অর্ধেক মুখটি। দেখা যাচ্ছে পরিপাটি করা আঁচড়ানো চুল। কালো কাঁচের চশমার পিছন থেকে বোঝা যাচ্ছে চোখের পলক বোজা। রাষ্ট্রপতি গলায় পরিয়ে দিচ্ছেন স্মারক পদকটি।
এটি তো একটি ফ্রেম মাত্র। একটি মুহূর্তের প্রতিফলন। কিন্তু যাঁরা সেই মুহূর্তটিতে উপস্থিত ছিলেন, তাঁদেরই একজন জানালেন হাতে-পায়ে কোনও সাড় নেই প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বাজপেয়ীর ঘরে প্রবেশ করার ঠিক পরেই অটলকে চেয়ারে বসিয়েই নিয়ে আসা হয়। এমন নয়, সেই সময় ৬ নম্বর কৃষ্ণ মেনন মার্গের বাড়ির লনটিতে আর কোনও ভিআইপি ছিলেন না। বিজেপির সংসদীয় বোর্ডের সদস্যরা প্রায় সকলেই ছিলেন অরুণ জেটলি, সুষমা স্বরাজ, রাজনাথ সিংহ, বেঙ্কাইয়া নায়ডু, নিতিন গডকড়ী। জম্মু-কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী মুফতি মহম্মদ সইদ, মধ্যপ্রদেশের শিবরাজ সিংহ চৌহান, রাজস্থানের বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়া, অন্ধ্রের চন্দ্রবাবু নায়ডু, পঞ্জাবের প্রকাশ সিংহ বাদল। শুধু কি তাই, সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবতও আরএসএসের আরও ৪ শীর্ষ নেতাকে নিয়ে উপস্থিত। ছিলেন উপরাষ্ট্রপতি, প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এপিজে আব্দুল কালামও। আর অবশ্যই অটলের বহু দিনের ছায়াসঙ্গী লালকৃষ্ণ আডবাণী, মুরলীমনোহর জোশী।
বিরোধী দলের মধ্যে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ, শরদ যাদব গিয়েছিলেন। যাননি সনিয়া গাঁধী। কিন্তু প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর উদার রাজনীতি, দেশাত্মবোধ ও বাগ্মিতার তারিফ করে তিনি চিঠি লেখেন বাজপেয়ীকে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও আজ ফেসবুকে লিখেছেন, “অটলজি ভারত রত্ন পাওয়ায় আমি খুব খুশি। উনিই সত্যিই এক বড় মাপের রাষ্ট্রনেতা।”
এত জন বাজপেয়ীর বাড়ির উঠোনে থাকলেও ভারতরত্ন দেওয়ার সময়টিতে কিন্তু কাউকে ঘরের ভিতরে প্রবেশের অধিকার দেওয়া হয়নি। সেখানে গিয়েছেন শুধু রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী। তাঁরা ভিতরে যেতেই বাজপেয়ীর জামাতা রঞ্জন ভট্টাচার্য ও সর্বক্ষণের চিকিৎসক বাজপেয়ীকে চেয়ারে বসিয়ে নিয়ে আসেন। সাধারণত গত কয়েক বছর ধরে যাঁরাই বাজপেয়ীকে দেখতে গিয়েছেন, তাঁরা বলছেন এটি এক বিরল মুহূর্তের জন্য বিরল প্রয়াস। তা না হলে বাজপেয়ীকে এখন সচরাচর চেয়ারেও বসানো হয় না। তাঁকে বেশির ভাগ সময়ই বিছানায় শুইয়ে রাখা হয়। তিনি কাউকে চিনতেও পারেন না। কথাও বলতে পারেন না সে ভাবে। বললেও, জড়ানো কথা বোঝা যায় না। সকাল বেলায় ফিজিওথেরাপিস্ট কিছু ব্যায়াম করান। সক্রিয় থাকতে খবর তাঁর পছন্দ ছিল। এখনও খবরের চ্যানেল চালিয়ে রাখা হয় তাঁর সামনে। মধ্যাহ্নভোজনের পরে বিশ্রাম। বিকেলের দিকে ও সন্ধেবেলা কিছুক্ষণ জেগে থাকেন। তখন তাঁর প্রিয় লতা মঙ্গেশকর ও মহম্মদ রফির কিছু গান চালানো হয়। তারপর তাড়াতাড়ি নৈশভোজ করিয়ে ফের ঘুম। এটাই তাঁর দিনলিপি।
ফলে যখন তাঁকে আজ ভারতরত্ন সম্মান দেওয়া হল, রাষ্ট্রপতিও কোনও কথা বলেননি। পদকটি তাঁর গলায় পরিয়ে দেন। কিন্তু মানপত্রটি তাঁর হাতে তুলে দিতে পারেননি। কারণ, বাজপেয়ীর মুখে ছিল না কোনও অভিব্যক্তি। হাতও ছিল অসাড়। মানপত্রটি জামাতা রঞ্জনের হাতেই তুলে দেন প্রণব। পরে নরেন্দ্র মোদী সেই বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়েই বলেন, “রাষ্ট্রপতি এখানে এসে যে ভাবে অটলবিহারী বাজপেয়ীর হাতে ভারতরত্ন সম্মান তুলে দিলেন, তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী তাঁর জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত কাটিয়েছেন দেশের জন্য। আমার মতো কোটি কোটি সাধারণ কর্মী রয়েছেন দলে। সকলের কাছে তিনি প্রেরণা। ভবিষ্যতের প্রজন্মও নিরন্তর প্রেরণা পাবেন তাঁর জীবন থেকে।” ৬ কৃষ্ণ মেনন মার্গের বাইরে এসে অরুণ জেটলি বললেন, “প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশের প্রতি তাঁর জনসেবা এবং একজন কবি, রাষ্ট্রবাদী ও সুবক্তা হিসেবে শুধু দেশেই নয়, বিদেশেও ছাপ ফেলেছেন বাজপেয়ী। দেশকে শক্তিশালী করতে তাঁর ভূমিকার জন্য এই সম্মান দিতে পেরে আমরা গর্বিত।”