—ফাইল চিত্র।
দেশের প্রথম সারির শিক্ষা, সংস্কৃতি, গবেষণা কেন্দ্রগুলির পর টিভি ও রেডিও। দূরদর্শন ও আকাশবাণীর নিয়ামক স্বশাসিত সম্প্রচার সংস্থা ‘প্রসার ভারতী’তেও এ বার গৈরিকীকরণের চেষ্টার অভিযোগ উঠল বিজেপি তথা সঙ্ঘের বিরুদ্ধে।
তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রকের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির একটি বৈঠকে এক আমলাকে না পাঠানো নিয়ে প্রসার ভারতীর সিইও জহর সরকারকে সম্প্রতি শো-কজ করেছেন সংস্থার চেয়ারম্যান সূর্য প্রকাশ। একটি পত্রিকার প্রাক্তন সম্পাদক সূর্য সঙ্ঘ-ঘনিষ্ঠ হিসেবেই পরিচিত। বিরোধীদের অভিযোগ, নরেন্দ্র মোদীর সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই দূরদর্শন ও আকাশবাণীর রাশ পুরোপুরি হাতে পেতে চাইছিল সঙ্ঘ। জহরবাবু সরে না যাওয়া পর্যন্ত সেই পথ সম্পূর্ণ মসৃণ হবে না। অথচ সিইও পদটি সাংবিধানিক হওয়ায় তাঁকে ‘ইমপিচ’ না করে সরানো সম্ভব না। বিরোধীদের দাবি, সেই কারণেই এমন পরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে, যাতে কোণঠাসা হয়ে জহরবাবু সরে যান। বস্তুত, নানা ঘটনায় ক্ষুব্ধ জহরবাবু এখন নিজে থেকেই ইস্তফা দিতে চাইছেন। আগামী বছরের গোড়ায় মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা তাঁর। কিন্তু তিনি চাইছেন তার আগেই ইস্তফা দিতে।
সিইও পদে জহরবাবু থাকলেন কি না, সেটা অবশ্য গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু যিনিই থাকুন তাঁকে ধামাধরা হতে হবে, মোদী সরকারের এমন মনোভাবের বিরুদ্ধেই সরব হয়েছেন বিরোধীরা। তাঁদের বক্তব্য, এ ভাবে শীর্ষ পদে নিজেদের লোক বসিয়ে প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টাটাই আপত্তিকর। বস্তুত, মোদী সরকার আসার পরে অন্তত এক ডজন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষে বহাল হয়েছেন বিজেপি তথা সঙ্ঘের ঘনিষ্ঠরা। সেই তালিকায় রয়েছে পুণে ফিল্ম ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউট (এফটিআইআই) থেকে শুরু করে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব হিস্টোরিক্যাল রিসার্চ, জওহরলাল নেহরু সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড সায়েন্টিফিক রিসার্চ, ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশনসের মতো সংস্থা। চেয়ারম্যান পদে গজেন্দ্র চৌহানকে বসানো নিয়ে দীর্ঘদিন অচলাবস্থা চলেছিল এফটিআইআই-তে। তাতে সরকারের অবশ্য হেলদোল দেখা যায়নি।
প্রসার ভারতীর চেয়ারম্যান পদটিও ফাঁকা ছিল দীর্ঘদিন। মোদী মসনদে আসার ছ’মাসের মধ্যেই সেই পদে নিয়োগ করা হয় সূর্য প্রকাশকে। বিরোধীদের বক্তব্য, চেয়ারম্যান পদে বসলেও সিইও-কে তিনি এই ভাবে কারণ দর্শানোর নোটিস পাঠাতে পারেন না। এই নোটিসের নেপথ্যে রয়েছে কেন্দ্রীয় তথ্য-সম্প্রচার মন্ত্রী অরুণ জেটলিকে লেখা কর্নাটকের সাংসদ ডি কে সুরেশের একটি চিঠি। সুরেশ সম্প্রতি অভিযোগ তোলেন, তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রকের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে প্রসার ভারতীর পদস্থ কর্তা মহেশ জোশীর (এডিজি, দক্ষিণ) বদলে জুনিয়র এক আমলাকে ‘ইচ্ছে করে’ পাঠানো হয়েছিল। অথচ ওই আমলা সে দিনের বৈঠকে কোনও প্রশ্নের সঠিক জবাব দিতে পারেননি। ফলে সভার কাজ কার্যত পণ্ড হয়ে যায়। অভিযোগ তোলা হয় যে, স্থায়ী কমিটির বৈঠককে আসলে গুরুত্বই দিতে চাননি প্রসার ভারতীর সিইও। তাই নিম্নপদস্থ আমলাকে পাঠিয়েছিলেন তিনি। এর পরেই জহরবাবুকে শো-কজের চিঠি দেন চেয়ারম্যান।
অনেকের অবশ্য দাবি, বিষয়টির সঙ্গে সঙ্ঘ পরিবারের সম্পর্ক নেই। এর নেপথ্যে রয়েছে প্রসার ভারতীরই অভ্যন্তরীণ সংঘাত। বৈঠক-বিতর্কে জহরবাবু ছাড়া আর যে তিন জন জড়িয়েছেন, সেই আমলা মহেশ জোশী, সাংসদ ডি কে সুরেশ এবং চেয়ারম্যান সূর্য প্রকাশ— তিন জনেই কর্নাটকের লোক। প্রসার ভারতী সূ্ত্রের দাবি, জোশীকে দূরদর্শনের ডিজি পদে বসাতে সক্রিয় ছিলেন কর্তাদের একাংশ। আপত্তি ছিল জহরবাবুর। শেষ পর্যন্ত ওই পদে মনোনীত হন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের প্রাক্তন যুগ্মসচিব সুপ্রিয়া সাহু। কাজেই সিইও এই দক্ষিণী লবির রোষে পড়লেন কি না, সেই প্রশ্ন থাকে।
সূত্রটির মতে, আরও একটি বিষয়ে প্রসার ভারতীর একাংশের বিরাগভাজন হয়েছেন জহরবাবু। সেটি হল, দূরদর্শনের সিরিয়াল নিয়ে দুর্নীতির তদন্ত। দূরদর্শনে দু’ধাঁচের ধারাবাহিক হয়ে থাকে। একটি হল, ‘স্পনসর্ড’। যেখানে সিরিয়ালের প্রযোজককে বিজ্ঞাপন জোগাড় করতে হয়। দ্বিতীয়টি, ‘কমিশন’। যেখানে দূরদর্শনে ধারাবাহিক দেখানোর জন্য প্রযোজককে কমিশন বাবদ টাকা দেয় প্রসার ভারতী। অটলবিহারী বাজপেয়ীর আমলে এই পদ্ধতি চালু করেছিলেন তৎকালীন তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী প্রমোদ মহাজন।
স্বাভাবিক ভাবেই অধিকাংশ প্রযোজক চান, ঘরের টাকা না লাগিয়ে কমিশন পদ্ধতিতে সিরিয়াল বানাতে। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে এই কমিশন পদ্ধতিতেই দুর্নীতির অভিযোগ উঠছিল। এমনও শোনা গিয়েছিল যে, এক-একটি সিরিয়ালের জন্য প্রযোজকদের কাছ থেকে প্রসার ভারতীর কর্তারা ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত ঘুষ চাইছেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এ ধরনের অভিযোগ জমা পড়ায় তা খতিয়ে দেখার জন্য সিবিআইয়ের কাছে পাঠিয়ে দেন জহরবাবু। এর পরেই ১৭ জনকে গ্রেফতার করে সিবিআই। নোটিস পাঠানো হয় প্রসার ভারতীর আরও ৪০ জনকে। সূত্রের দাবি, এর পরেই অনেকটা একঘরে হয়ে পড়তে শুরু করেন জহরবাবু।
তবে বিরোধীরা এই যুক্তি মানছেন না। তাঁদের অভিযোগ, গোটাটাই আসলে সঙ্ঘ পরিবারের নিয়ন্ত্রণের রাজনীতি। গণ্ডগোলের কথা কানে গিয়েছে প্রধানমন্ত্রীরও। তিনি আপাতত জেটলিকে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে বলেছেন। সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলা শুরু করেছেন জেটলি।