ধ্বংস হয়ে যাওয়া গাড়ির অংশ সরানো হচ্ছে ক্রেন দিয়ে। ছবি: এপি।
‘হাউ ইজ দ্য জোশ?’
উরি সিনেমার সংলাপটিকে হাতিয়ার করে প্রচারে নেমে পড়েছিলেন বিজেপি নেতারা। কারণে-অকারণে যত্রতত্র টেনে আনছিলেন সংলাপটি। পরিকল্পনা ছিল, লোকসভার নির্বাচনের প্রচারে আরও ব্যাপক ভাবে বাক্যটিকে ব্যবহার করা হবে। নানা বিষয়ে বিরোধীদের বিদ্রুপের জবাব হয়ে উঠবে ‘হাউ ইজ দ্য জোশ’!
কিন্তু বিকেলে উপত্যকার মাটিতে গত কয়েক দশকের সবচেয়ে বড় জঙ্গি হামলার পরে চুপ শাসক শিবির। জোশ উধাও! উল্টে লোকসভার আগে কী ভাবে পুলওয়ামার ক্ষত মেটানো যায়, তা ভাবতেই নাজেহাল বিজেপি। সরকারি ভাবে দলের তরফে এখনও মুখ খোলেননি কোনও মুখপাত্রই। কেবল ঘটনার নিন্দা ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করার হঁশিয়ারি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
‘কড়া পদক্ষেপ’ করার জন্য সরকারের উপর চাপ বাড়িয়েছে সঙ্ঘপ্রধান মোহন ভাগবত। ‘প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ’ মানে কি আবার সার্জিকাল স্ট্রাইক? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ শুধু বলছেন, ‘‘কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’
সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলা সম্পর্কে এগুলি জানেন? খেলুন কুইজ
ভারতীয় সেনা সম্পর্কে এই তথ্যগুলি জানতেন?
পরিসংখ্যান বলছে, গত পাঁচ বছরে কাশ্মীর ছাড়া দেশের কোথাও বড় মাপের কোনও জঙ্গি হামলা না হলেও যে ভাবে সেনা কনভয় বা সেনা ছাউনিতে হামলা হয়েছে, তা আগের অনেক রেকর্ডই ভেঙে দিয়েছে। এ নিয়ে বহু দিন ধরেই সরব কংগ্রেস। দলের বক্তব্য, পঠানকোট থেকে উরি হয়ে পুলওয়ামা— শুধু জম্মু-কাশ্মীরেই অন্তত ১৮টি বড় মাপের হামলা হয়েছে মোদী জমানায়। মারা গিয়েছেন কয়েকশো জওয়ান। কংগ্রেসের মুখপাত্র রণদীপ সুরজেওয়ালা বলেন, ‘‘গত পাঁচ বছরে ৪৬০ জন জওয়ান ও ২৮০ জন নাগরিক জঙ্গি হামলায় মারা গিয়েছেন। সরকার যে কাশ্মীর নীতির প্রশ্নে সম্পূর্ণ ব্যর্থ, এ দিনের পরে তা ফের স্পষ্ট হয়ে গেল।’’
আরও পড়ুন: ৩৫০ কেজি বিস্ফোরকের গাড়িবোমা কাশ্মীরে, হত ৪৪ সিআরপিএফ জওয়ান
প্রশ্ন উঠেছে সার্জিকাল স্ট্রাইকের যৌক্তিকতা নিয়েও। উরি হামলার পরে সার্জিকাল স্ট্রাইক করেছিল ভারত সেনা। তা নিয়ে তৈরি সিনেমারই পরিচিত সংলাপ, ‘হাউ ইজ দ্য জোশ’! বিজেপির দাবি ছিল, ওই সার্জিকাল স্ট্রাইকের ফলে জঙ্গিদের কোমর ভেঙে দেওয়া গিয়েছে। কিন্তু ঘটনা হল, তার পরেও গোটা শীত জুড়ে উপত্যকায় অভিযান জারি রাখতে হয়েছে সেনাকে। প্রায় ফি-দিন নিকেশ করা হয়েছে একাধিক জঙ্গিকে। এবং তার পরেও আজ যে ভাবে কয়েকশো কেজি বিস্ফোরক নিয়ে জঙ্গিরা হামলা চালাল, তা থেকে স্পষ্ট, উপত্যকায় এখনও যথেষ্ট সক্রিয় ভারত-বিরোধী জঙ্গিগোষ্ঠীগুলি।
আরও পড়ুন: রাস্তায় পড়ে নিহতদের ব্যাগ-রুকস্যাক, কান্না চেপে সেগুলো কুড়চ্ছেন সেনারা
অথচ, মোদী সরকার ক্ষমতায় এসেই জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালের হাতে বকলমে কাশ্মীরের দায়িত্ব তুলে দিয়েছে। শুরু থেকেই দমননীতি নিয়ে চলার সিদ্ধান্ত নেয় কেন্দ্র। কিন্তু পাঁচ বছর শেষে পরিসংখ্যান বলছে, তাতে আখেরে লাভের চেয়ে ক্ষতিই হয়েছে বেশি। কাশ্মীরের রাজনৈতিক দলগুলির মতে, মাত্রাতিরিক্ত দমননীতি দেখে ফের কাশ্মীরের যুবকেরা হাতে অস্ত্র তুলে নিচ্ছেন। এঁদের মধ্যে রয়েছেন কলেজ পড়ুয়া থেকে পিএইচডি-তে নাম লেখানো মেধাবী ছাত্রও।
এ দিনের হামলার পরে আরও একটি বিষয় নিয়ে অস্বস্তি তৈরি হয়েছে মোদী সরকারের অন্দরমহলে। এই মুহূর্তে জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যপালের শাসনে, অর্থাৎ কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণে। তার মধ্যেই এতবড় হামলা, যার দায় উপত্যকার কোনও দলের ঘাড়ে চাপানো কঠিন হয়ে পড়েছে মোদী সরকারের পক্ষে।
পাকিস্তান নীতির ক্ষেত্রেও সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে আজ সরব হয়েছে কংগ্রেস। তাদের কথায়, ‘‘পাঁচ বছরে পাঁচ হাজার বার ভারতের সীমান্ত লক্ষ করে গুলি চালিয়েছে পাক সেনা। সেনাদের মাথা কেটে নিয়ে গিয়েছে পাক সেনা। মোদী সরকারের আমলে পাক গোয়েন্দাদের পঠানকোটের ঘাঁটি ঘুরে দেখতে দেওয়া হয়। এটা সরকারের নরম নীতির ফল বলেই অভিযোগ সুরজেওয়ালার। তাঁর কথায়, ‘‘পাঁচ বছর তো হয়ে গেল। আর কবে মোদী তাঁর ৫৬ ইঞ্চির ছাতি দিয়ে ভারতকে সুরক্ষা দেবেন?’’
এ দিকে আজকের ঘটনার পরেই ফের পারস্পরিক চাপানউতোর শুরু হয়ে গিয়েছে স্বরাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের ভিতরে। সূত্র বলছে, তুষারপাতের কারণে দিন তিনেক বন্ধ থাকার কারণে এ দিন কনভয়ে গাড়ির সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ ছিল। রাস্তার নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল সেনার রোড ওপেনিং দল। স্বরাষ্ট্র সূত্র বলছে, যে রাস্তা দিয়ে কনভয় যাচ্ছিল, তার পাশের রাস্তা থেকে এসে হামলা চালায় জঙ্গি-গাড়িটি। যাকে আটকানোর দায়িত্ব ছিল সড়কের সুরক্ষার দায়িত্ব থাকা দলের। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক প্রাথমিক ভাবে মনে করছে, ওই দলের গাফিলতির কারনেই গত দু’দশকের সবচেয়ে বড় হামলাটি ঘটেছে।