এক দফায় বা অন্য কোনও অবৈধ ভাবে তিন তালাক দিলে এ বার তিন বছরের জেল হবে। এমনই আইন করতে চলেছে নরেন্দ্র মোদীর সরকার। সুপ্রিম কোর্ট এই ধরনের তালাককে অবৈধ ও অসাংবিধানিক আখ্যা দিয়েছে আগেই। কিন্তু এই কাজের জন্য শাস্তির বিধান নেই বর্তমান দণ্ডবিধিতে। এই ক্ষেত্রে অন্যান্য আইন ব্যবহার করতে হচ্ছিল। সেই ফাঁক পূরণে ফোন-চিঠি-ইমেল বা মুখে— এক দফায় তিন বার তালাক দেওয়াকে ফৌজদারি অপরাধের তকমা দিয়ে এর জন্য শাস্তির ব্যবস্থা করতে চলেছে কেন্দ্র। সংসদের শীতকালীন অধিবেশন শুরুর দিনেই আজ কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা এই সংক্রান্ত ‘মুসলিম মহিলাদের বৈবাহিক অধিকার সুরক্ষা বিল’-এ সিলমোহর বসিয়েছে।
সরকারি সূত্রের খবর, বিলে বলা হয়েছে, শুধুমাত্র তাৎক্ষণিক তিন তালাক বা ‘তালাক-এ-বিদ্দত’-এর ক্ষেত্রেই ফৌজদারি আইন প্রযোজ্য হবে। মৌখিক, লিখিত বা ই-মেল, এসএমএস-এ তিন তালাকও নিষিদ্ধ কাজ ও ফৌজদারি অপরাধের তালিকায় পড়বে। তিন বছরের জেল ও জরিমানার বিধান থাকবে। এমন তালাকের ফলে বিপদে পড়া মহিলারা নিজেদের ও সন্তানের ভরণপোষণের জন্য ভাতা পেতে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছেও দরবার করতে পারবেন। জম্মু-কাশ্মীর ছাড়া সর্বত্রই এই আইন প্রযোজ্য হবে। উত্তরপ্রদেশের ভোটে নরেন্দ্র মোদীর অন্যতম হাতিয়ার ছিল এই তাৎক্ষণিক তালাকের প্রসঙ্গ। সুপ্রিম কোর্টেও তাৎক্ষণিক তিন তালাকের বিরুদ্ধে সওয়াল করেছিল মোদী সরকার।
বিজেপি মনে করে, উত্তরপ্রদেশে মুসলিম মহিলাদের ভোটও তাঁদের ঝুলিতে এসেছে। এ বারে গোটা দেশেই মুসলিম ভোটব্যাঙ্কের কিছুটা ভাগ পেতে চাইছেন মোদী-অমিত শাহরা। এত দিন যা অধরাই ছিল বিজেপির। মুসলিম মহিলাদের সংগঠনগুলি আজ মোদী সরকারের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে।
আরও পড়ুন: কীসের ‘অবসর’, জল্পনা ওড়াল দলই
অল ইন্ডিয়া মুসলিম উওমেন পার্সোনাল ল’ বোর্ডের নেত্রী সায়িস্তা আম্বর বলেন, ‘‘এই সরকার আগের সরকারের মতো নয়। মুসলিম মহিলাদের অধিকারকে গুরুত্ব দেয়।’’ সংসদে বিল পেশ হওয়ার পর সব দলই যাতে এটিকে সমর্থন করে, তার জন্যও আর্জি জানিয়েছেন সায়িস্তা।
মোদী সরকার আশা করছে, এই অধিবেশনেই বিলটি পাশ করিয়ে নেওয়া যাবে। কারণ, কেউই এতে বিরোধিতা করতে চাইবে না। কিন্তু কংগ্রেসের বক্তব্য, তাৎক্ষণিক তিন তালাককে নিষিদ্ধ করে সুপ্রিম কোর্টের রায়কে কংগ্রেসও স্বাগত জানিয়েছে। কিন্তু আজ কংগ্রেস নেতা অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি মনে করিয়ে দেন, এখানে মানুষের কোনও কাজকে ফৌজদারি অপরাধের তালিকায় ফেলা হচ্ছে। তাই শীর্ষ আদালতের রায়ের সঙ্গে মোদী সরকারের বিলের সামঞ্জস্য রয়েছে কি না, তা ভাল ভাবে খতিয়ে দেখতে হবে।
বিভিন্ন দলের সমর্থন জোগাড় করতে ইতিমধ্যেই মাঠে নেমে পড়েছে ‘ভারতীয় মুসলিম মহিলা আন্দোলন’-ও। আদালতের আইনি লড়াইয়ে মুম্বইয়ের এই সংগঠনটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। সংগঠনের নেত্রী জাতিয়া সোমান ও নুরজহান সফিয়া নিয়াজ ইতিমধ্যেই রাহুল গাঁধী, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অখিলেশ যাদব, মায়াবতী, সীতারাম ইয়েচুরি-সহ বিরোধী শিবিরের সব নেতানেত্রীকে চিঠি লিখে এই বিলে সমর্থন জানানোর অনুরোধ জানিয়েছেন। তাঁদের যুক্তি, সুপ্রিম কোর্ট ‘তালাক-এ-বিদ্দত’ নিষিদ্ধ করলেও নিকাহ হালালা, বহুবিবাহ, সন্তানের ভরণপোষণের মতো সমস্যা এখনও মেটেনি।
‘তালাক-এ-বিদ্দত’কে ফৌজদারি অপরাধের তকমা দেওয়ার ঘোর বিরোধিতা করছেন এআইএমআইএম নেতা আসাউদ্দিন ওয়াইসি। আপত্তি জানিয়ে কেন্দ্রের আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদকে চিঠিও লিখেছেন তিনি। তাঁর প্রশ্ন, এক দিকে স্বামীকে জেলে পাঠানোর বিধান দেওয়া হচ্ছে। আবার ভরণপোষণেরও বন্দোবস্ত করতে বলা হচ্ছে। দু’টি এক সঙ্গে কী ভাবে সম্ভব? ওয়াইসির অভিযোগ, রাজনৈতিক স্বার্থে মুসলিম সমাজকে দানবীয় চেহারা দেওয়া হচ্ছে।
অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ডের মতে, সরকারের উচিত ছিল আইন তৈরির আগে সকলের সঙ্গে আলোচনা করা। অন্তত মুসলিম সমাজের মতামত শোনা। বোর্ডের মুখপাত্র মৌলানা সাজ্জাদ নোমানির যুক্তি, ‘‘আমরাও তাৎক্ষণিক তিন তালাক বন্ধ করতে চাই। কিন্তু উপর থেকে আইন চাপিয়ে দেওয়াটা ঠিক নয়।’’ সরকারের যদিও যুক্তি, বিলটি তৈরির আগে সব রাজ্যেরই মতামত চাওয়া হয়েছিল।