ছক ভাঙাই চমক প্রভুর

ট্রেন না বাড়িয়ে নজর স্বাচ্ছন্দ্য এবং উন্নয়নে

পূর্বসূরিরা যে পথে হেঁটে এসেছেন, তা বদল করার সাহস দেখালেন সুরেশ প্রভু। তাঁর রেল বাজেটে ভাড়া বাড়েনি ঠিকই। ঘোষণা হল না কোনও নতুন ট্রেন। বড় মাপের কোনও নতুন প্রকল্পও নেই। সহজ পথে বাজিমাতের চেষ্টা ছেড়ে প্রভু জোর দিয়েছেন পরিষেবা ও পরিকাঠামো উন্নতির উপরে। তার জন্য কোন পথে রেলের অভিমুখ হওয়া উঠিত, সেই দিগ্নির্দেশ করার চেষ্টা করেছেন তিনি।

Advertisement

অনমিত্র সেনগুপ্ত

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৩:৩৯
Share:

রেল বাজেট পেশ করতে চলেছেন রেলমন্ত্রী সুরেশ প্রভু। বৃহস্পতিবার সংসদে। ছবি: পিটিআই।

পূর্বসূরিরা যে পথে হেঁটে এসেছেন, তা বদল করার সাহস দেখালেন সুরেশ প্রভু।

Advertisement

তাঁর রেল বাজেটে ভাড়া বাড়েনি ঠিকই। ঘোষণা হল না কোনও নতুন ট্রেন। বড় মাপের কোনও নতুন প্রকল্পও নেই। সহজ পথে বাজিমাতের চেষ্টা ছেড়ে প্রভু জোর দিয়েছেন পরিষেবা ও পরিকাঠামো উন্নতির উপরে। তার জন্য কোন পথে রেলের অভিমুখ হওয়া উঠিত, সেই দিগ্নির্দেশ করার চেষ্টা করেছেন তিনি।

এ দেশে রেল বাজেট বরাবরই রাজনৈতিক হাতিয়ার। মন্টেক সিংহ অহলুওয়ালিয়াদের মতো যোজনা কমিশনের কর্তাদের বারণ সত্ত্বেও, গত এক দশক ধরে একের পর জনমোহিনী ঘোষণা করে গিয়েছেন প্রাক্তন রেলমন্ত্রীরা। যার ফলে ক্রমশ শুকিয়ে গিয়েছে রেলের স্বাস্থ্য। যেমন ভর্তুকি বেড়েছে, পাল্লা দিয়ে বেড়েছে লোকসানের বোঝা। ক্রমশ গতি হারিয়েছে রেলের চাকা। যাত্রী পরিষেবা শিকেয় উঠেছে। সুরক্ষা ব্যবস্থাও প্রশ্নের মুখে।

Advertisement

নরেন্দ্র মোদী সরকারের এই প্রথম পূর্ণাঙ্গ রেল বাজেটে এত দিনের উপেক্ষার জায়গাগুলিতেই নজর দেওয়া হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সেই কাজে অনেকটাই সফল হয়েছেন মন্ত্রী সুরেশ প্রভু। সাংসদেরা নিজেদের এলাকার জন্য কোনও ঘোষণা শুনতে না পেয়ে ক্ষুব্ধ হয়েছেন ঠিকই, কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাস্তবতার নিরিখে এটা সুচিন্তিত পদক্ষেপ। যার চমক কম, কিন্তু কার্যকরী।

শুরু থেকেই হাত-পা বাঁধা। সামর্থ্যও সীমিত। যাত্রী কমায় গত বারের চেয়ে আয় কমেছে প্রায় হাজার কোটি টাকা। ফলে বাজেটে আয় বুঝে ব্যয় করার পথেই এগিয়েছেন প্রভু। স্বপ্নের ফেরিওয়ালা না হয়ে নিজের লক্ষ্যকে ভেঙেছেন দু’ভাগে। রেলের সাময়িক ও দীর্ঘমেয়াদি উন্নতি। একে ম্যানেজমেন্টের লোক, তায় সামনে কোনও নির্বাচন নেই। তাই তিনি পরিষেবা ও পরিকাঠামো উন্নতির উপরই জোর দিতে চেয়েছেন। আর তাতে ভরসা করেছেন বেসরকারি বিনিয়োগের উপরই।

প্রভু প্রথমেই জোর দিয়েছেন পরিষেবা ক্ষেত্রের খোলনলচে বদলে ফেলার উপর। এক ধাক্কায় যাত্রী পরিষেবা খাতে ৬৭% বরাদ্দ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। রেল বলতেই জনমানসে যে নেতিবাচক ছবি ফুটে ওঠে, সেটিই সবার আগে বদল করতে চেয়েছেন মোদী-প্রভু জুটি।

প্রথমেই টিকিট কাটার সময়সীমা দু’মাস থেকে বাড়িয়ে করে দিয়েছেন চার মাস। এর ফলে অনেক আগেই রেলের হাতে চলে আসবে টিকিটের টাকা। বাতিল টিকিট থেকেও অর্থ রোজগার বাড়বে। আগামী দিনে এসএমএস নির্ভর টিকিট ব্যবস্থা সর্বস্তরে চালু করার উপরও জোর দিতে চেয়েছেন প্রভু। এমনকী শহরতলির প্যাসেঞ্জার ট্রেনেও ওই ব্যবস্থা চালু করতে চান তিনি। ট্রেনের খাবার নিয়ে নিত্যদিনের ঝামেলা। তাই প্রাথমিক ভাবে ১০৮টি ট্রেনে চালু হচ্ছে ই-কেটারিং। যাত্রীরা চাইলে নিজেদের ইচ্ছে মতো খাবার চলে আসবে চলন্ত ট্রেনে। অভিযোগ থাকলে নিখরচার হেল্পলাইনে জানানো যাবে। মহিলা সুরক্ষার জন্য নির্ভয়া তহবিলের ব্যবহার করে কামরায় সিসিটিভি ও বিশেষ হেল্পলাইন নম্বর চালু করা হবে বলেও জানিয়েছেন প্রভু। এ ছাড়া যাত্রী সুরক্ষার জন্য বিশেষ কর্পোরেট সেফ্টি প্ল্যানও এ বছরের জুনে চালু করতে চলেছেন প্রভু। পরিচ্ছন্নতার প্রশ্নে নতুন কোচগুলিতে বায়ো টয়লেট ছাড়াও, পুরানো কোচগুলিতে ভ্যাকুয়াম টয়লেট বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে রেল। জোর দেওয়া হয়েছে চলন্ত ট্রেনের সাফ-সাফাইয়ের ওপর।

খাবার ও স্বচ্ছতা তো হল। এ বার মনোরঞ্জনের পালা। চলন্ত ট্রেনে এ বার টিভির ব্যবস্থা করছে রেল। প্রাথমিক ভাবে ওই ব্যবস্থা দিল্লি-চণ্ডীগড় শতাব্দী এক্সপ্রেসে চালু হবে। বয়স্ক যাত্রীদের সিঁড়ি ভেঙে মিডল বা আপার বার্থে ওঠা একটি বড় সমস্যা। তা ছাড়া সিঁড়িগুলির উচ্চতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। তাই ভবিষ্যতে কোচের নক্সা পরিবর্তনের জন্য ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ডিজাইনের সাহায্য নিতে চলেছে রেল। প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ মূল্যে আরও প্রায় দশ হাজার চারশো কোটি টাকা দরকার। সন্দেহ নেই, সময় যত গড়াবে, মুদ্রাস্ফীতির অঙ্ক মেনে অঙ্কটা আরও বাড়বে। একই ভাবে কাঁচরাপাড়া, ডানকুনি, নোয়াপাড়া, খড়্গপুর, লিলুয়া-সহ রাজ্যের একাধিক রেল কারখানা ও ওয়ার্কশপের জন্য বাজেটে প্রায় ৯০ কোটি টাকা বরাদ্দের কথা বলা হয়েছে। বাস্তব হল, এই প্রকল্পগুলির কাজ শেষ করতেও প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন। আবার তারকেশ্বর-বিষ্ণুপুর, আরামবাগ-ইরপালা নতুন লাইন নির্মাণ, লক্ষীকান্তপুর শাখায় নতুন লাইনের সম্প্রসারণ, তমলুক-দীঘা-নন্দীগ্রাম এবং দীঘা-জলেশ্বরের মতো একাধিক লাইনের কাজ এগোনোর জন্য নাম মাত্র টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। অথচ ওই প্রকল্পগুলি রূপায়ণের জন্য কোথাও আরও চারশো কোটি টাকা প্রয়োজন, কোথাও আটশো কোটি, কোথাও বা ছ’শো কোটি টাকা।

প্রশ্ন হল, এ জন্য দায়ী কে?

বাজেট বরাদ্দে এই ছাঁটাই নিয়ে রাজনৈতিক আক্রমণ ও সমালোচনার ঝড় যে উঠবে, তা অজানা ছিল না। রেলমন্ত্রী সুরেশ প্রভুর। তাই তাঁর বাজেট বক্তৃতা শেষ হওয়ার পরেই রেল মন্ত্রক ব্যাখ্যা দিতে নেমে পড়ে। মন্ত্রকের এক কর্তা বলেন, “রেলমন্ত্রী বুঝিয়ে দিয়েছেন, দায় তাঁর নয়। চাইলেই টাকা পাওয়া যাবে, এমন গৌরী সেনের অবস্থা আর রেলের নেই! বাজার থেকে টাকা তোলার চেষ্টা হচ্ছে। তাতে সরকার সফল হলে তবেই কাজ এগোবে।” ওই আমলার পাল্টা প্রশ্ন, “রেলের হাঁড়ির খবর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানতেন না?” মন্ত্রক সূত্রে বলা হচ্ছে, রেলের আর্থিক অবস্থার কথা বিচার না করে কেবল মাত্র রাজনৈতিক কারণেই রেলমন্ত্রী থাকাকালীন কল্পতরু হয়েছিলেন মমতা। কিন্তু ওই বিপুল পরিমাণ টাকার যোগান দেওয়া কতটা কঠিন, তা বিলক্ষণ জানতেন মমতা বা তাঁর দলের উত্তরসূরিরা। টাকার যোগান বাড়াতে কিছুই করেননি তাঁরা। উল্টে এমন এমন পদক্ষেপ করেছেন, যাতে বোঝা বেড়েছে। উদাহরণ দিতে গিয়ে তাঁরা বলছেন, গোটা দেশে মেট্রো রেল ও শহুরে দ্রুত গতির যান ব্যবস্থার জন্য সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে প্রকল্প গড়া হচ্ছে। যেমন দিল্লি মেট্রো বা মুম্বই, হায়দরাবাদ, বেঙ্গালুরু, কোচি মেট্রো। কিন্তু শুধু রাজনৈতিক কারণেই কলকাতায় মেট্রো রেল সম্প্রসারণের কাজ জোর করে রেলের ঘাড়ে এনে ফেলেছেন তৃণমূলনেত্রী! একই ভাবে ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো প্রকল্পকেও সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ থেকে রেলে আনা হয়েছে তাঁর আমলে। অথচ বিদেশি আর্থিক সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে মেট্রো প্রকল্পগুলি যৌথ উদ্যোগে রূপায়ণের পথে হাঁটলে সেগুলির অগ্রগতি হতো। আবার বাজেটে যে ৫৮২ কোটি টাকা মেট্রোর জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে, তা প্রান্তিক প্রকল্পগুলিতে বিনিয়োগ করা যেত। অর্থাৎ এমন অন্তত পঞ্চাশটি প্রকল্প রাজ্যে রয়েছে, যেখানে আরও দশ বা পনেরো কোটি টাকা খরচ করলে আগামী অর্থবর্ষেই কাজ শেষ হয়ে যেতো। তার সুফল পেত বাংলাই।

শুধু তাই নয়, মেট্রো রেল প্রকল্পগুলিতে কম বরাদ্দের জন্য মন্ত্রকের আরও একটি যুক্তি রয়েছে। তা হল, জমি অধিগ্রহণ বা স্থানীয় সমস্যার জন্য সেখানে কাজ এগোচ্ছে না। এমনকী নির্মাণ সামগ্রী রাখার জন্যও জমি পাওয়া যাচ্ছে না! ফলে অতিরিক্ত বরাদ্দ করলেও তা খরচ হতো কি না, সন্দেহ!

কিন্তু এই তত্ত্বের কচকচি বা যুক্তিজাল কি নরেন্দ্র মোদী সরকারকে সমালোচনার হাত থেকে বাঁচাতে পারবে?

বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি যখন প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে, তখন এই রেল বাজেট কি তাদের সমস্যায় ফেলবে না? বিজেপি নেতৃত্ব অবশ্য তেমনটা মনে করছেন না। কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়র কথায়, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্রেফ পপুলিজম করেছেন, কাজ করেননি! রেলের কাছে মানুষের প্রাথমিক চাহিদা যাত্রী স্বাচ্ছন্দ্য, পেশাদারিত্বের সঙ্গে স্টেশন পরিচ্ছন্ন রাখা, ট্রেনে খাবার ও পানীয়ের সুব্যবস্থা ইত্যাদি। মোদী সরকার তাতে অগ্রাধিকার দিয়েছে। দিল্লি ও কলকাতার মধ্যে আরও দ্রুতগামী ট্রেন চালানোর অঙ্গীকার করা হয়েছে বাজেটে।” একই সঙ্গে সমালোচনা ঠেকাতে তাঁর যুক্তি, “বড় কথা হল, আর্থিক সঙ্কট সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গ যে বরাদ্দ পেয়েছে, তা পূর্ব ভারতে আর কোনও রাজ্য পায়নি।”

মন্ত্রী বাবুলের এই দাবি অবশ্য কানেই তুলছে না তৃণমূল। রাজ্যের বঞ্চনার বিষয়টিকে সামনে রেখে বাজেট পেশের পরেই সমালোচনায় মুখর হয়েছে তারা। বরাদ্দ নিয়ে বাবুলের দাবি ফুৎকারে উড়িয়ে দিতে চেয়েছেন প্রাক্তন রেলমন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদী বা বর্ষীয়ান তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায়। দীনেশের কটাক্ষ, “সবই প্রভুর মায়া! সে ছাড়া আর কিছু নেই বাজেটে!” রেল বাজেট বিতর্কে এ নিয়ে সরব হওয়ার প্রস্তুতি আজ থেকেই শুরু করে দিয়েছে তৃণমূল। একই সঙ্গে তাদের বক্তব্য, পুরভোটের আগে তৃণমূলের হাতে ভাল অস্ত্র তুলে দিয়েছে বিজেপি।

বিজেপিকে অবশ্য কিছুটা স্বস্তি দিয়েছেন তৃণমূলেরই একজন! প্রাক্তন রেলমন্ত্রী মুকুল রায়! রেলভাড়া বাড়ানোর ‘অপরাধে’ দীনেশ ত্রিবেদীকে সরিয়ে মমতা যাঁকে রেলমন্ত্রী করেছিলেন। রেল বাজেট নিয়ে তৃণমূলের ঝাঁঝালো প্রতিক্রিয়ার বিপরীতে দাঁড়িয়ে মুকুল এ দিন বলেন, “সাধারণ মানুষের উপর ভাড়ার বোঝা বাড়েনি, এটা সুখবর। যথেষ্ট বাস্তবসম্মত রেল বাজেট হয়েছে বলা যায়” একই সঙ্গে তাঁর কৌশলী মন্তব্য, “পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রকল্প যেগুলি মমতা বন্দ্যেপাধ্যায়, দীনেশ ত্রিবেদী এবং আমার সময়ে শুরু করা হয়েছিল, সেগুলি পূর্বতন কংগ্রেস সরকারের আমলে থমকে গিয়েছে। এগুলিকে অবিলম্বে চালু করা দরকার।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন