বৈঠকের পথে রাজনাথ সিংহ। সঙ্গে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার, অসমের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ। শনিবার গুয়াহাটিতে। ছবি: উজ্জ্বল দেব।
ভারত-মায়ানমার সীমান্তে বসবাসকারী ২৪০ টি গ্রামের ২ লক্ষ বাসিন্দা একান্ত ভাবেই জঙ্গিদের দয়ার উপরে নির্ভরশীল! মানবাধিকার সংগঠনের দাবি নয়, রীতিমতো বিবৃতি দিয়ে এ কথা মেনে নিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ। একইসঙ্গে তিনি স্বীকার করলেন, ভুটান সীমান্তে থাকা গ্রামগুলিরও একই অবস্থা। ভারত-মায়ানমার সীমান্ত সংক্রান্ত সমস্যা মেটাতে বিশেষ কমিটি গড়ার কথা ঘোষণার পাশাপাশি, উত্তর-পূর্বের ৮টি রাজ্যের রাজ্য সরকারের কাছে সীমান্তে বেড়া বসানোর জন্য পর্যাপ্ত জমিও চাইলেন রাজনাথ।
এ দিকে, খাপলাংদের সঙ্গে সংঘর্ষবিরতি ভাঙার জন্য কেন্দ্রকে দোষ দিয়ে নাগাল্যান্ডের মুখ্যমন্ত্রী জানিয়ে দেন, রাজ্য সরকার মায়ানমারে খাপলাং-এর সঙ্গে দেখা করে আলোচনা চালানোর জন্য রাজ্যের দুই সংগঠনের প্রতিনিধিদের ইয়াঙ্গন পাঠাচ্ছে। জঙ্গিদের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি নেওয়ার পাশাপাশি আজ গুয়াহাটিতে রাজনাথ বলেন, ‘‘উত্তর-পূর্বের কিছু অংশ বাদ দিয়ে সন্ত্রাস আগের চেয়ে অনেক কমেছে। তাই, শান্তির বাতাবরণ আনতে, কেন্দ্রীয় বাহিনীর সংখ্যা কতটা কমানো যায়, সেই বিষয়ে রাজ্যগুলির মত জানতে চাওয়া হয়েছে।’’
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক সূত্র বলছে, উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলির ক্ষেত্রে এই ঘোষণা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। খাপলাং গোষ্ঠীর হুমকি থাকা সত্ত্বেও যে ভাবে এ দিন রাজনাথ গোটা উত্তর-পূর্বে সেনা কমানোর ইঙ্গিত দিয়েছেন তা দেখে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের ব্যাখ্যা— এর মাধ্যমে কেন্দ্র বোঝাতে চাইছে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল এখন আগের থেকে অনেক বেশি শান্ত। তা ছাড়া উত্তর-পূর্বের বাসিন্দাদের একটি বড় অংশ দীর্ঘ সময় ধরে সেনা প্রত্যাহারের দাবিতে সরব রয়েছে। ইতিমধ্যেই সামরিক বাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইন সম্প্রতি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে ত্রিপুরাতে। সেই পথ ধরেই এ বার গোটা উত্তর-পূর্ব থেকে ধীরে ধীরে সেনা কমানোর পরিকল্পনা রয়েছে কেন্দ্রের। এক দশক আগে জঙ্গি সমস্যা যখন তীব্র ছিল সে সময়ে তার মোকাবিলায় বিপুল সংখ্যায় সেনা মোতায়েন করা হয় উত্তর-পূর্বাঞ্চলে। তাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের মতে, বিষয়টি সময়সাপেক্ষ। ধাপে ধাপে সেনা কমানো হবে।
এ বিষয়ে রাজনাথ বলেন,‘‘আগের চেয়ে পরিস্থিতি অনেক শান্ত। তাই আমি উত্তর-পূর্বের সমস্ত মুখ্যমন্ত্রীদের কাছে তাঁদের কত কেন্দ্রীয় বাহিনী সত্যি প্রয়োজন তা খতিয়ে দেখার জন্য আবেদন জানিয়েছি।’’ মন্ত্রক বলছে, মুখ্যমন্ত্রীদের দেওয়া রিপোর্টের ভিত্তিতে প্রথম ধাপে সেনা কমাবে কেন্দ্র।
গুয়াহাটিতে এ দিন উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলির মুখ্যমন্ত্রী, পুলিশ-প্রধান, সেনা-বিএসএফ-আসাম রাইফেল্সর কর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন রাজনাথ। সঙ্গে ছিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কিরেণ রিজিজু, স্বরাষ্ট্র সচিব লক্ষ্মীচাঁদ গয়াল, জয়েন্ট ইন্টেলিজেন্স কমিটির চেয়ারম্যান তথা কেন্দ্র-এনএসসিএন (আইএম)-এর শান্তি আলোচনার মধ্যস্থতাকারী আর এন রবি। বৈঠকে উত্তর-পূর্বের সন্ত্রাস সমস্যার পাশাপাশি, সীমানা বিবাদ ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের দিকগুলি নিয়েও আলোচনা হয়.।
বৈঠকে সবচেয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয় ভারত-মায়ানমার সীমান্ত সমস্যার উপরে। এক দিকে খাপলাং বাহিনী সংঘর্ষবিরতি ভেঙে নাশকতা চালাচ্ছে, অন্য দিকে শান্তি আলোচনা চালানোর পাশাপাশি এনএসসিএন আই-এম হুমকি দিচ্ছে, তাদের সংগঠনকে কর না দিলে চরম শাস্তি মিলবে। এই পরিস্থিতিতে নাগাল্যান্ড সরকার কেন্দ্রকে সক্রিয় হতে অনুরোধ করে। নাগাল্যান্ডের মুখ্যমন্ত্রী টি আর জেলিয়াং রাজনাথকে যে রিপোর্ট দেন, সেখানে কেন্দ্রকে সরাসরি দোষারোপ করে তিনি বলেন, ‘‘কেন্দ্র যদি সংঘর্ষবিরতি ভঙ্গের বিষয়টি রাজ্যকে জানাত তবে, রাজ্য সরকার নিজের তরফে বা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনদের মধ্যস্থতায় খাপলাংকে সংঘর্ষবিরতি চালিয়ে যাওয়ার জন্য রাজি করানোর চেষ্টা করত। রাজনাথ সাফ জানান, খাপলাংরা কোনও আলোচনা না করে একত রফা সংঘর্ষবিরতি ভঙ্গ করেছে। তাদের নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ভারত কখনওই চুক্তি ভাঙতে চায়নি।
মণিপুরের দাবি, সংঘর্ষবিরতিতে থাকা কেএনও ও ইউপিএফ-এর ছাতার তলায় থাকা ছোট জঙ্গি সংগঠনগুলি নাশকতা ও অপরাধ চালাচ্ছে। তাদের সংঘর্ষবিরতির আওতা থেকে বাদ দেওয়া হোক। মণিপুরের জাতীয় সড়কগুলিতে বছরের অধিকাংশ সময় জঙ্গি সংগঠন বা অন্যান্য সংগঠনের বন্ধ-অবরোধ থাকায় রাজ্যবাসী নাকাল হচ্ছেন বলে কেন্দ্রের কাছে অভিযোগ জানান ইবোবি। নিয়ম করে নিত্যপণ্যবাহী ট্রাকগুলি প্রহরা দিয়ে পাঠাবার জন্য অতিরিক্ত কেন্দ্রীয় বাহিনী চেয়েছে মণিপুর।
রাজনাথ মেনে নেন, মায়ানমার সীমান্তে থাকা দুই লক্ষাধিক মানুষ জঙ্গিদের দয়ার উপরে নির্ভরশীল. মায়ানমার, ভুটান ও বাংলাদেশ সীমান্তের ও পারে ঘাঁটি গেড়ে থাকা জঙ্গিরা গারো পাহাড়, বড়োভূমি, নাগাল্যান্ড, মণিপুরে সমস্যা সৃষ্টি করছে। কিন্তু, সেই সব গ্রামে পুলিশ-প্রশাসনের ছাতা নেই। ডিমাপুরের মতো শহর বেআইনি অস্ত্রের ঘাঁটি হয়ে উঠেছে। ভারত-মায়ানমার সীমান্ত উন্নয়ন, অস্ত্র-মাদক চোরাচালান রোধে আর এন রবির নেতৃত্বে কমিটি গড়া হয়েছে। তাঁরা শীঘ্র সমীক্ষা রিপোর্ট জমা দেবে। তার ভিত্তিতে কেন্দ্র ব্যবস্থা নিতে চলেছে।
রাজনাথ জানান, মিজোরাম, ত্রিপুরা, অসমের অনেকটা অংশ, মেঘালয়ের একাংশে নাশকতা নেই বললেই চলে। মণিপুর-নাগাল্যান্ডের মানুষও শান্তির প্রতীক্ষায়। এই অবস্থায় সন্ত্রাস-কেন্দ্রীক নিরাপত্তা নয়, জনতা-কেন্দ্রীক নিরাপত্তার উপরেই বেশি জোর দিতে চায় কেন্দ্রীয় সরকার। কেন্দ্রীয় বাহিনী কমানোর কথা বললেও, এখনই আফস্পা প্রত্যাহারের কথা নিয়ে কোনও আলোচনার সুযোগ নেই বলে জানান রাজনাথ। নাগাল্যান্ড সরকার রাজ্য থেকে আফস্পা প্রত্যাহারের দাবিও তোলে। ইনারলাইন পারমিট চালুর দাবিতে মণিপুর উত্তাল। একই দাবি রয়েছে মেঘালয়েও। মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী আর্জি জানান, উত্তর-পূর্বের সব রাজ্যের জন্য এ ক্ষেত্রে একই আইন চালু করা হোক।অসমের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ জানান, বর্তমানে রাজ্যে ৮টি সক্রিয় ও ১৩টি সংঘর্ষবিরতিতে থাকা জঙ্গি সংগঠন রয়েছে। এরমধ্যে আলফা, এনডিএফবি, কেএলও খাপলাং-এর সঙ্গে হাত মেলানোয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে তা বড় আশঙ্কা হয়ে দেখা দিয়েছে। সেই সঙ্গে মাওবাদী ও জিহাদিদেরও ঘাঁটি হয়েছে অসমে। এজন্য গগৈ মোবাইলে আরও বেশি নজরদারি, এসএমএসে নজরদারি, ও সংবেদনশীল এলাকায় গুপ্তচর বাড়াবার পক্ষে সওয়াল করেন।