ছাড় শুধু বিদেশে থাকলে

পুরনো ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বদল বন্ধ রিজার্ভ ব্যাঙ্কেও

নতুন বছরের প্রথম কাজের দিনে এখনও ঘরে রয়ে যাওয়া বাতিল নোট আঁকড়ে রিজার্ভ ব্যাঙ্কমুখো হয়েছিলেন অনেকে। কিন্তু সেখানে পৌঁছে মাথায় হাত। তাজ্জব বনে দেখতে হল, খোদ প্রধানমন্ত্রী কথা দেওয়া সত্ত্বেও পুরনো পাঁচশো ও হাজারের নোট পাল্টানোর দরজা মুখের উপর বন্ধ করেছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক!

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৩ জানুয়ারি ২০১৭ ০৪:০৯
Share:

বদল হল না নোট। বেঙ্গালুরুতে। ছবি: এএফপি

নতুন বছরের প্রথম কাজের দিনে এখনও ঘরে রয়ে যাওয়া বাতিল নোট আঁকড়ে রিজার্ভ ব্যাঙ্কমুখো হয়েছিলেন অনেকে। কিন্তু সেখানে পৌঁছে মাথায় হাত। তাজ্জব বনে দেখতে হল, খোদ প্রধানমন্ত্রী কথা দেওয়া সত্ত্বেও পুরনো পাঁচশো ও হাজারের নোট পাল্টানোর দরজা মুখের উপর বন্ধ করেছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক!

Advertisement

৮ নভেম্বর নোট নাকচের দিনে নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, ‘‘যাঁরা কোনও কারণে ৩০ ডিসেম্বরের মধ্যে পুরনো ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট (ব্যাঙ্কে) জমা দিতে পারবেন না, তাঁরা রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কিছু অফিসে সেই সুবিধা পাবেন ৩১ মার্চ পর্যন্ত।’’ অথচ ৩১ ডিসেম্বর নিজেদের ওয়েবসাইটে দেওয়া বিবৃতিতে শীর্ষ ব্যাঙ্ক জানিয়েছে, নোট বদলের সুবিধা আপাতত জারি রইল শুধু সেই সব ভারতীয় নাগরিকের জন্য, যাঁরা ৯ নভেম্বর থেকে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে ছিলেন না। সুযোগ পাবেন সেই সমস্ত অনাবাসী ভারতীয়ও, যাঁরা ওই সময়ের মধ্যে দেশে আসেননি। প্রথম ক্ষেত্রে ৩১ মার্চ পর্যন্ত শীর্ষ ব্যাঙ্কের কিছু নির্দিষ্ট শাখায় (কলকাতা, মুম্বই, নয়াদিল্লি, চেন্নাই ও নাগপুর) বাতিল নোট বদলে নেওয়ার সুযোগ মিলবে। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে ওই সময়সীমা ৩০ জুন পর্যন্ত। তবে নেপাল, ভুটান, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশে প্রবাসী হলে অবশ্য এই সুবিধা মিলবে না।

শীর্ষ ব্যাঙ্কের মুখপাত্র তথা প্রিন্সিপাল অ্যাডভাইজর আল্পনা কিল্লাওয়ালাকে প্রশ্ন করা হলেও তিনি জানান, নতুন নিয়মে আর কেউ ওই নোট বদলের সুবিধা পাবেন না।

Advertisement

নতুন বছরে এ দিনই ছিল রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রথম কাজের দিন। তাই কলকাতা, মুম্বই, দিল্লির মতো শহরে শীর্ষ ব্যাঙ্কের সামনে বাতিল দুই নোট নিয়ে হাজির হয়েছিলেন অনেকে। নিশ্চিত ছিলেন যে, তা বদলাতে লাইন দিতে হতে পারে কিন্তু হয়রান হতে হবে না। খোদ প্রধানমন্ত্রী কথা দিয়েছেন যে। কিন্তু অভিজ্ঞতা হয়েছে ঠিক উল্টো। এর আগে টাকা বদল ও জমা নিয়ে হঠাৎ পাল্টে যাওয়া নিয়মে দেশের সাধারণ মানুষকে হয়রান হতে হয়েছে। অবাক হয়ে দেখতে হয়েছে যে, ধোপে টিকছে না খোদ প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁদের আশা ছিল, বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কে যা-ই হোক, অন্তত রিজার্ভ ব্যাঙ্কে তেমনটা ঘটবে না। কিন্তু শেষমেশ তা-ও হয়নি। বাম পরিষদীয় নেতা সুজন চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘প্রধানমন্ত্রী আরও এক বার দেশের মানুষকে ধোঁকা দিলেন।’’ এ দিন কলকাতায় শীর্ষ ব্যাঙ্কের সামনে রাজ্যের দুই মন্ত্রী অরূপ রায় ও রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে বিক্ষোভ দেখায় তৃণমূলও।

অবশ্য নোট বাতিলের পর থেকেই নিজেদের সুনামের মর্যাদা রাখতে পারেনি শীর্ষ ব্যাঙ্কও। বিরোধীরা তোপ দেগেছেন, রিজার্ভ নয়, এ তো ‘রিভার্স’ ব্যাঙ্ক! নোট বাতিলের দিন থেকে যার কাজই হয়েছে নিত্যনতুন ঘোষণা করা আর দু’দিন না যেতেই তা পাল্টে ফেলা। অনেকের মতে, এই সর্বশেষ ঘোষণাও সেই লাগাতার ডিগবাজির ‘মুকুটে নতুন পালক’।

যেমন, প্রথমে কেন্দ্র ও রিজার্ভ ব্যাঙ্ক জানিয়েছিল, ৪০০০ টাকা পর্যন্ত অঙ্কের বাতিল নোট বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কে সরাসরি বদলে নেওয়া যাবে। পরে তা কমিয়ে করা হল ২,০০০। শেষমেশ তা তুলেই দেওয়া হল।

এখানেই শেষ নয়। গোড়ায় দাবি ছিল, ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত নিজের অ্যাকাউন্টে আড়াই লক্ষ টাকা পর্যন্ত জমা দিলে সমস্যা হবে না। অথচ ১৯ ডিসেম্বর শীর্ষ ব্যাঙ্ক হঠাৎই জানায়, বাতিল নোটে এক লপ্তে ৫,০০০ টাকার বেশি একটি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা দিতে হলে, ৩০ ডিসেম্বরের মধ্যে তা করা যাবে আর এক বারই। সে ক্ষেত্রেও জিজ্ঞাসাবাদ করবেন অন্তত দু’জন অফিসার। সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিয়ে তবেই টাকা অ্যাকাউন্টে জমা করা যাবে। বারবার অল্প করে জমা দিতে থাকলেও সেই টাকা যোগ হবে। মোট ৫,০০০ ছাড়ালে একই ভাবে পড়তে হবে প্রশ্নের মুখে।

অথচ সেই দিনই ঠিক উল্টো কথা বলেন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। আর এর পর ৪৮ ঘণ্টা না কাটতেই ডিগবাজি। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক জানায়, বাতিল নোটে এক লপ্তে ৫,০০০ টাকার বেশি একটি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা দিলে, প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে না। ৩০ ডিসেম্বরের মধ্যে টাকা জমাও দেওয়া যাবে যত বার খুশি!

এ বারও রিজার্ভ ব্যাঙ্কের এমন আচমকা নিয়ম বদলে প্রশ্ন উঠছে, এমন করা হল কেন? গোড়ায় কেন্দ্রের দাবি ছিল, নোট বাতিলের ধাক্কায় আর ব্যাঙ্কে ফিরবেই না অন্তত ২-৩ লক্ষ কোটি কালো টাকা। অথচ দেখা যাচ্ছে ফিরছে প্রায় পুরোটা। অনেকের প্রশ্ন, বাতিল নোটের কিছুটা আটকে মুখ বাঁচাতেই কি এমন সিদ্ধান্ত?

প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ থেকে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন— সকলেই বলেছেন, ব্যাঙ্কের এমন হঠকারী সিদ্ধান্তে তার প্রতি মানুষের আস্থা টাল খায়। যা অর্থনীতির বিপদ ডেকে আনে। এ দিনও নোট জমা দিতে আসা ক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষ প্রশ্ন তুলেছেন, যদি খোদ প্রধানমন্ত্রী আর রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কথাতেই আস্থা রাখা না যায়, তাহলে বিশ্বাস করব কাকে?

এমনকী যাঁদের জন্য নোট বদলের দরজা আপাতত খোলা রইল, তাঁদের উপর চাপানো শর্তও খুব একটা পরিষ্কার নয়। যেমন, ভারতীয় নাগরিকদের ক্ষেত্রে ৯ নভেম্বর থেকে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের বাইরে থাকার প্রমাণ চাওয়া হয়েছে। অনাবাসীদের দেখাতে হবে ওই সময়ে তাঁরা দেশে আসেননি। প্রশ্ন হল, কেউ যদি ২৮ বা ২৯ তারিখে দেশে এসে থাকেন? আর চাইলেই বা কেউ শেষ দিনের ভরসায় নোট বদলের কাজ ফেলে রাখতে পারবেন না কেন?

নোট বদলাতে এসে ব্যর্থ এক বয়স্ক এ দিন আক্ষেপ করছিলেন, ‘‘ভুল আমারই। বিশ্বাস করেছিলাম!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন