নিপা ভাইরাস: এখনই ভয় পাবেন না, তবে...

২০ বছর আগে প্রথম যখন তার খবর পাওয়া যায়, এখানে ১০ জন, ওখানে ৫ জন, এ ভাবে মানুষ আক্রান্ত হয়েছিলেন৷ বছর দেড়েকের মধ্যে অবশ্য সে তার খেলা দেখাতে শুরু করে৷ ভাইরাস সংক্রমণে মালয়েশিয়াতে ২৬৫ জন এনসেফেলাইটিসে (ব্রেনের এক রকম জটিল প্রদাহ) আক্রান্ত হন৷

Advertisement

সুজাতা মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৩ মে ২০১৮ ১৬:৩৬
Share:

কোঝিকোর মেডিক্যাল কলেজে এএফপির তোলা ছবি।

ভাগাড়-কাণ্ডের পর মাংসের পাট ছিল না বললেই চলে৷ তা-ও যে ক’জন অসমসাহসী মানুষ চালিয়ে যাচ্ছিলেন, এ বার তাঁরাও ব্যাকফুটে৷ খাওয়ার জন্য কে আর প্রাণ দিতে চায়! অতএব শুয়োরের মাংসের পাট এ বার উঠল৷ উঠল ফল–ফলাদির পাট৷ কোনটার মধ্যে যে ভাইরাস ঢুকে বসে আছে আর কোনটায় নেই, তা বোঝার যখন কোনও রাস্তা নেই, যদিও ভাইরোলজির তাবড় তাবড় অধ্যাপকেরা জানিয়ে দিয়েছেন, কেরালার দুঃসংবাদে আমাদের ভীত হওয়ার কারণ নেই৷ কারণ নিপা ভাইরাস যতই ভয়ঙ্কর হোক না কেন, সে মোটের উপর এলাকাতেই সীমাবদ্ধ থাকে৷ ভয় তবু যায় না৷ এই ভাইরাস তো একেবারে নবাগত৷ মেরেকেটে ২০ বছর আগে এসেছে সে৷ বিজ্ঞানীরা কি আর এর মধ্যেই তার নাড়িনক্ষত্র সব জেনে ফেলেছেন?

Advertisement

২০ বছর আগে প্রথম যখন তার খবর পাওয়া যায়, এখানে ১০ জন, ওখানে ৫ জন, এ ভাবে মানুষ আক্রান্ত হয়েছিলেন৷ বছর দেড়েকের মধ্যে অবশ্য সে তার খেলা দেখাতে শুরু করে৷ ভাইরাস সংক্রমণে মালয়েশিয়াতে ২৬৫ জন এনসেফেলাইটিসে (ব্রেনের এক রকম জটিল প্রদাহ) আক্রান্ত হন৷ তার মধ্যে মারা যান ১০৫ জন৷ বিজ্ঞানীরা জানতে পারেন, এই সংক্রমণ এসেছে মূলত শুয়োর থেকে৷ এবং যাঁরা মারা গিয়েছেন ও যাঁদের রোগ হয়েছে তাঁদের বেশির ভাগই শুয়োর প্রতিপালনের সঙ্গে কোনও না কোনও ভাবে যুক্ত৷ তা হলে কোন সাহসে মানুষ আর তবে শুয়োরের মাংস খাবেন?

এখানেই শেষ নয়৷ ১৯৯৯-তে সিঙ্গাপুরে ১১ জন অসুস্থ হওয়ার পর ২০০১ সালে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় ও শিলিগুড়িতে তার পদার্পণ ঘটে৷ এর পর ২০০৩, ২০০৪, ২০০৫— প্রতি বছরই নিয়ম করে বাংলাদেশে সে বিভীষিকা ছড়িয়েছে৷ তার পরও চলেছে তার প্রতাপ৷ আর এখন সে একেবারে দোরগোড়ায়৷ ভগবানের নিজস্ব দেশে৷ বছরভর কত মানুষ তো কেরল বেড়াতে যান, কোজিকোডে–র মতো সৈকত শহরে যান। কাজে কাজেই তাঁদের শরীরে যদি কোনও অছিলায় ভাইরাস ঢুকে পড়ে সেখান থেকে...

Advertisement

আরও পড়ুন: আর দেখা হবে না, মৃত্যুর আগে নার্সের শেষ চিঠি স্বামীকে

একেবারে যে পারে না তা নয়৷ কারণ রোগ তো শুধু শুয়োর বা ফল থেকে ছড়ায় না, ছড়ায় মানুষ থেকে মানুষেও! কাজেই কেউ যদি সেখান থেকে রোগ নিয়ে ফেরেন তাঁর থেকে তো অন্য লোকেরও রোগ হতে পারে আবার ফল–ফলাদিও এ রাজ্য থেকে সে রাজ্যে পাড়ি দেয়৷ পাড়ি দেয় শুয়োরের মাংস৷ তার মাধ্যমে কি ভাইরাস পাড়ি দিতে পারে না?

বিশিষ্ট চিকিৎসক অধ্যাপক সুকুমার মুখোপাধ্যায়ের মতে, ‘‘এ ভাবে রোগ ছড়ানো যে অসম্ভব তা নয়৷ তবে চিকিৎসক ও সাধারণ মানুষ যদি এ ব্যাপারে সচেতন থাকেন যে এ রকম একটা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব হয়েছে, রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করা সহজ হবে৷ প্রথমত, মানুষ কিছু প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে পারবেন ও সাধারণ জ্বর–মাথাব্যথা হলেও তড়িঘড়ি ডাক্তারের পরামর্শ নেবেন৷ ফলে রোগ জটিল হওয়ার আশঙ্কা কিছুটা কমবে৷ দ্বিতীয়ত, ডাক্তার যদি এ ব্যাপারে সতর্ক থাকেন, জটিল রোগী এলে তিনি চট করে রোগের কথা ভেবে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে পারবেন৷ তাতেও বিপদের আশঙ্কা কমবে৷ তবে সত্যি বলতে কি, এত আতঙ্কিত হওয়ার মতো কিছু কিন্তু আমি এই মুহূর্তে দেখছি না৷’’

বাদুড় সরাসরি মানুষকে সংক্রামিত করে না৷ কারণ, ভাইরাসের মূল ঘাঁটি যে বিশেষ ধরনের বাদুড়, তারা বনেবাদাড়ে, গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকতেই ভালবাসে৷ জনসমক্ষে বিশেষ আসে না৷ আর এদের মধ্যে এক শতাংশেরও কম বাদুড় এই ভাইরাস দিয়ে সংক্রামিত হয়৷ আর তা থেকে সরাসরি মানুষের বিপদ হয় না৷ তবে হ্যাঁ, এই বাদুড়েরা শুয়োরকে সংক্রামিত করতে পারে৷ ফলকে করতে পারে৷ সেখান থেকে এলাকার মানুষের মধ্যে বিপদ ছড়াতে পারে৷ আবার শুয়োর থেকে রোগ ছড়াতে পারে কুকুর, বিড়াল, ছাগল, ঘোড়াতেও৷

ভয়ের কি সত্যিই কিছু নেই? এ এমন এক রোগ যাকে ঠেকানোর কোনও উপায় নেই, সাপোর্টিভ থেরাপি ছাড়া, চিকিৎসা বলতে গেলে কিছু নেই৷ ভাইরাসের দাপটে মাথায় প্রদাহ পৌঁছে গেলে বা শ্বাসনালী আক্রান্ত হলে তো নির্ঘাৎ মৃত্যু!

সুকুমার মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন, ‘‘হ্যাঁ, এ কথা ঠিক যে এ রোগে আক্রান্ত হলে প্রায় অর্ধেক রোগীর ক্ষেত্রেই তা বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছে যেতে পারে৷ তবে এ রোগ কমবয়সীদের বেশি হয় বলে খুব তাড়াতাড়ি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিলে বিপদ অনেকটাই ঠেকিয়ে দেওয়া যায়৷ তবে তার জন্য উপসর্গের গতিপ্রকৃতির দিকে ভাল করে নজর রাখা দরকার৷’’

উপসর্গ

ভাইরাসের সংস্পর্শে আসার ৩–১৪ দিনের মধ্যে উপসর্গ শুরু হয়৷ প্রথমে জ্বর মাথাব্যথার মতো সাধারণ কষ্ট থাকে, যাকে সাধারণ ফ্লু বলে মনে হতে পারে৷ কিন্তু এর সঙ্গে যদি রোগী আচ্ছন্ন হয়ে যান, ভুল বকা শুরু হয়, কাউকে চিনতে না পারেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব উপযুক্ত পরিষেবা আছে এমন হাসপাতালে তাঁকে ভর্তি করতে হবে৷ কারণ, বাড়াবাড়ি সংক্রমণে ২৪–৪৮ ঘণ্ঢার মধ্যে রোগী কোমা স্টেজে চলে যেতে পারেন৷ ব্রেনে প্রদাহ হলে, যাকে বলে এনসেফেলাইটিস, অবস্থা গুরুতর হয়ে ওঠে৷ রোগের প্রথম দিকে অনেকের শ্বাসকষ্ট হয়৷ এঁদের থেকেই রোগ ছড়ায় বেশি৷ সে জন্য রোগীকে আলাদা করে রাখতে হয়৷ সতর্ক থাকতে হয় সেবাকর্মীদের৷ তা হলে আর রোগ ছড়ানোর ভয় তত থাকে না৷

রোগের ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আদুল ইসলাম বলেন, ‘‘যেখানে রোগ হয়নি সেখানে সাধারণ ভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে যে সব নিয়ম মেনে চলতে বলা হয়, যেমন, পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যকর ভাবে থাকা, নাকে–মুখে হাত দেওয়ার আগে বা খাবার খাওয়ার আগে হাত ভাল করে ধুয়ে নেওয়া ইত্যাদি, সেটুকু মানলেই চলে৷ তবে যেখানে রোগ হচ্ছে সেখানে তার সঙ্গে আরও কয়েকটি নিয়ম মানা জরুরি৷ যেমন, শুয়োরের থেকে সব রকম দূরত্ব বজায় রাখা, সমস্যা না মেটা পর্যন্ত ফল খাওয়া বন্ধ করা, ঘরে পরিচ্ছন্ন ভাবে বানানো সুসিদ্ধ খাবার খাওয়া, রাস্তাঘাটে বেরনোর সময় মাস্ক পরে নেওয়া, এন৯৫ মাস্ক পরে নিলে বিপদের আশঙ্কা কম থাকে৷ রোগীর সেবা যাঁরা করেন তাঁদের মাস্ক পরা ও হাত ধোয়ার ব্যাপারে আরও বেশি সতর্ক হওয়া দরকার৷’’

রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা

সাধারণ পরীক্ষায় এ রোগ ধরা পড়ে না৷ থ্রোট সোয়াব, অর্থাৎ গলা থেকে তরল নিয়ে রিয়েল টাইম পলিমারেজ চেইন রিঅ্যাকশন নামের পরীক্ষা করা হয়৷ শিরদাঁড়ার তরল, ইউরিন ও রক্ত পরীক্ষাও করতে হয়৷ সেরে ওঠার পর রোগটা নিপা ভাইরাস থেকেই হয়েছিল কিনা জানতে আইজিজি ও আইজিএম অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করে দেখা হয়৷

চিকিৎসা বলতে মূলত সাপোর্টিভ কেয়ার, আগেই বলা হয়েছে৷ অর্থাৎ রোগীর কষ্টের উপশম করার চেষ্টা করা হয়৷ জটিল অবস্থায় ইনটেনসিভ থেরাপি ইউনিটে ভর্তি করে চিকিৎসা করতে হয়৷

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন