পোয়েজের প্রাসাদ থেকে জেল কুঠুরি

সাক্ষী থাকল মেরিনা সৈকত।গত ৭ ডিসেম্বর জয়ললিতার মরদেহ নিয়ে বিশাল শোকযাত্রা পৌঁছেছিল এই বেলাভূমিতে, যার পুরোভাগে ছিলেন শশিকলা। মাঝে দু’মাস সাত দিনের ব্যবধান। আজ আরও একটি মিছিল ছুঁয়ে গেল সেই সৈকত, যার পুরোভাগে সেই শশিকলাই। দুর্নীতির অভিযোগে জেলে চলেছেন তিনি।

Advertisement

অনমিত্র সেনগুপ্ত

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০৩:৩১
Share:

আদালতে পৌঁছলেন শশিকলা। বুধবার বেঙ্গালুরুতে। ছবি: পিটিআই।

সাক্ষী থাকল মেরিনা সৈকত।

Advertisement

গত ৭ ডিসেম্বর জয়ললিতার মরদেহ নিয়ে বিশাল শোকযাত্রা পৌঁছেছিল এই বেলাভূমিতে, যার পুরোভাগে ছিলেন শশিকলা। মাঝে দু’মাস সাত দিনের ব্যবধান। আজ আরও একটি মিছিল ছুঁয়ে গেল সেই সৈকত, যার পুরোভাগে সেই শশিকলাই। দুর্নীতির অভিযোগে জেলে চলেছেন তিনি।

জয়ললিতার পরে তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে কে বসবেন তা নিয়ে সংঘাত চলছিল শশিকলা ও পনীরসেলভমের মধ্যে। কিন্তু গত কাল সুপ্রিম কোর্টের রায়ে ভেস্তে যায় শশিকলার মুখ্যমন্ত্রিত্বের স্বপ্ন। জেল যাত্রা যাতে অন্তত কিছু দিন রোখা যায়, সেই চেষ্টার কসুর করেননি শশী। সেই উদ্দেশ্যে আজ তাঁর আইনজীবী কেটিএস তুলসী বিচারপতি পিনাকীচন্দ্র ঘোষের এজলাসে আবেদনে জানান— শশিকলা আত্মসমর্পণের আগে সব দিক গুছিয়ে নিতে কিছু দিন সময় চান। পত্রপাঠ সেই আবেদন খারিজ করে দেন পিনাকীবাবু। উল্টে শশিকলাকে অবিলম্বে বেঙ্গালুরু আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়ে বিচারপতি বলেন, ‘‘আশা করি আপনি অবিলম্বে শব্দটির অর্থ জানেন। অবিলম্বে মানে অবিলম্বে!’’ রায়ের চব্বিশ ঘণ্টা পরেও শশিকলা কেন আত্মসমর্পণ করেননি, তা নিয়েও বিস্ময় প্রকাশ করেন বিচারপতি।

Advertisement

সুপ্রিম কোর্টের এই নির্দেশে জেল যাত্রা নিশ্চিত হতেই ঘুঁটি সাজাতে শুরু করেন শশিকলা। গত কালই অনুগত ই পালানিসামিকে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী নির্বাচিত করে সরকারে নিজের প্রভাব নিশ্চিত করতে চেয়েছেন শশী। এর পরে জেলে থাকা অবস্থায় দলে তাঁর প্রভাব অক্ষুণ্ণ রাখতে ফিরিয়ে আনেন তাঁর ভাইপো তথা জয়ললিতার হাতে বহিষ্কৃত হওয়া টি টি ভি দিনকরন ও এস বেঙ্কটেশকে। দিনকরনকে দলের উপ-সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করেন শশী। সাধারণ সম্পাদক শশী জেলে থাকায় আগামী দিনে পদের বিচারে দু’নম্বর দিনকরনের হাতেই থাকতে চলছে দল পরিচালনার ভার।

আরও পড়ুন:

বিতাড়িত ভাইপোকে দলে ঢুকিয়ে, দায়িত্বে বসিয়ে জেলে গেলেন শশিকলা

শশী যখন ঘুঁটি সাজাচ্ছেন, তখন পনীরসেলভম শিবির অভিযোগ তোলে— গত কাল রাতে রিসর্টে থাকা বিধায়কদের সমর্থন কিনতে প্রত্যেককে ১০ কেজি করে সোনার বিস্কুট উপহার দিয়েছেন শশী। অভিযোগ উঠেছে, এডিএমকে বিধায়কদের মাথাপিছু ১০০ কোটি টাকা দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে স্ট্যালিনের দল ডিএমকে। তবে শর্ত হল, শাসক দলের বিধায়কদের ইস্তফা দিতে হবে। যাতে নতুন করে নির্বাচন হতে পারে ওই রাজ্যে। দাবি-পাল্টা দাবির মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রশ্নে এখনও অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছেন পনীরসেলভম। যদিও বিজেপির একটি বড় অংশ পনীরসেলভমকেই মুখ্যমন্ত্রী দেখতে চান। কিন্তু ঘনিষ্ঠ মহলে বিজেপি নেতারা মেনে নিচ্ছেন যে, যথেষ্ট বিধায়ক না থাকার কারণেই পনীরসেলভম বুক ঠুকে সরকার গড়ার দাবি জানাতে পারছেন না। এ দিকে আজ শশিকলা জেলের উদ্দেশে রওনা দিতেই তাঁর বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে অপহরণের অভিযোগ দায়ের করেছেন মাদুরাইয়ের বিধায়ক সর্বানন। সেই অভিযোগের ভিত্তিতে তামিলনাড়ু পুলিশ শশিকলা, পালানিসামি-সহ শশী শিবিরের একাধিক নেতার বিরুদ্ধে অপহরণ ও হুমকি দেওয়ার মামলা দায়ের করেছে। অভিযোগের তদন্ত করতে আজ ফের ওই রিসর্টে যায় পুলিশ। যদিও শশী-ঘনিষ্ঠ বিধায়কদের দাবি, তাঁরা স্বেচ্ছায় ওই রিসর্টে রয়েছেন।

এ দিন দলের রাশ নিজের হাতে রাখা নিশ্চিত করার পরেই বেঙ্গালুরু আদালত ছুঁয়ে সেখানকার পারাপ্পানা অগ্রহারা জেলের উদ্দেশে রওয়ানা হন শশী। ডজন দুয়েক গাড়ির কনভয় প্রথমে পৌঁছয় মেরিনা সৈকতে জয়ললিতার সমাধিস্থলে। সেখানে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ বিলাপ করার পরে জয়ার সমাধির উপরে তিন বার চাপড় মেরে শশীকে মৃদু স্বরে কিছু বলতে দেখা যায়। শশী শিবিরের দাবি— জেলে থাকলেও রাজ্যের উন্নয়নে জয়ললিতার অসমাপ্ত কাজ শেষ করার প্রতিজ্ঞা করেন নেত্রী। এর পর বেঙ্গালুরুগামী কনভয় থামে রামপুরমে এডিএমকে-র প্রতিষ্ঠাতা এমজিআরের বাড়ির সামনে। সেখানেও এমজিআরের ছবির সামনে বসে প্রার্থনা করেন শশী। মিনিট দশেক পরে সোজা বেঙ্গালুরুর উদ্দেশে পাড়ি দেন শশী। বিকেল পাঁচটা নাগাদ পৌঁছন বেঙ্গালুরু জেলে। সঙ্গে একই মামলায় কারাদণ্ড পাওয়া বোনপো সুধাকরন ও বৌদি এলাভরসি।

পনীরসেলভমের বাড়ির সামনে জনতার ঢেউ। ছবি- এএফপি

সূত্রের খবর, জেল সুপারের কাছে শশী আবেদন করেন— ওই জেলের যে কামরায় জয়ললিতা বন্দি ছিলেন, ঠিক তার পাশের কামরাটি যেন তাঁকে দেওয়া হয়। একই সঙ্গে শশী শিবিরের পক্ষ থেকে নেত্রীর জন্য এসি কামরা, টিভি, বোতলবন্দি জল, ধ্যানকক্ষ ও সর্বক্ষণের এক জন মহিলা জেলকর্মী রাখার আবেদন জানানো হয়। যদিও সেই দাবি খারিজ করে দিয়েছেন জেল কর্তৃপক্ষ। সূত্রের খবর, আর পাঁচ জন কয়েদির মতো শশীকে থাকতে হবে সাধারণ কামরাতেই। সাধারণ কয়েদিরা যা খান, তাই বরাদ্দ হয়েছে তাঁর জন্য। তাঁর সঙ্গে একই সেলে রয়েছেন এলাভরসি।

তবে আদালতের রায়ের পরে প্রায় চল্লিশ ঘণ্টা কেটে যাওয়ার পরেও মুখ্যমন্ত্রিত্বের প্রশ্নে ধোঁয়াশা রেখে দিয়েছেন রাজ্যপাল সি বিদ্যাসাগর রাও। শশী শিবিরের নেতা পালানিসামি না প্রতিদ্বন্দ্বী পনীরসেলভম— সমর্থন প্রমাণে কাকে তিনি ডাকতে চলেছেন তা নিয়ে কিছুই স্পষ্ট করতে চাননি রাজ্যপাল। এরই মধ্যে আজ সন্ধ্যায় পালানিস্বামী ও পনীরসেলভম— উভয় শিবিরই ফের বিদ্যাসাগর রাওয়ের সঙ্গে দেখা করে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণের সুযোগ দেওয়ার দাবি জানান। তামিলনাড়ুর অচলাবস্থার ঢেউ এসে আছড়ে পড়েছে দিল্লিতেও। আজ শশী শিবিরের নেতা থাম্বিদুরাই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দেখা করেন। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি এ নিয়ে বলেন, ‘‘এটা এডিএমকে-র অভ্যন্তরীণ বিষয়। রাজ্যপাল সাংবিধানিক প্রথা মেনে খুব দ্রুত ব্যবস্থা নেবেন। এতে কেন্দ্রের কোনও বক্তব্য নেই।’’

সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পরিস্থিতিতে ৪ রকম সিদ্ধান্ত নিতে পারেন রাজ্যপাল। প্রথমত, অ্যাটর্নি জেনারেল মুকুল রোহতগির পরামর্শ মেনে বিধানসভায় দু’শিবিরের নেতাকে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণের সুযোগ দিতে পারেন রাজ্যপাল। দ্বিতীয়ত, পালানিসামি বা পনীরসেলভমের মধ্যে কোনও এক জনকে ডেকে তাঁকে মুখ্যমন্ত্রী হতে বলে সাত দিনের মধ্যে তাঁকে বিধানসভায় গরিষ্ঠতা প্রমাণের নির্দেশ দিতে পারেন। তৃতীয়ত, শাসক দলে মতানৈক্যের কারণে প্রধান বিরোধী দল ডিএমকে-কে সরকার গড়তে সুযোগ দিতে পারেন রাজ্যপাল। চতুর্থত, বিধানসভা জিইয়ে রেখে সাময়িক ভাবে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করতে পারেন তামিলনাড়ুতে।

এই চারটি সম্ভাব্যের মধ্যে রাজ্যপাল এখন কোনটা বেছে নেন সেটাই দেখার। তবে সূত্রের মতে, বিধানসভায় ভোটাভুটির যে পরামর্শ মুকুল রোহতগি দিয়েছেন, সম্ভবত সেই পথেই হাঁটবেন রাজ্যপাল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন