পৃথিবীর সর্বোচ্চ যুদ্ধক্ষেত্রে অতন্দ্র প্রহরায় ভারতীয় সেনা।
চারিদিকে ১৮ থেকে ২০ হাজার ফুট উঁচু পাহাড়। আদিগন্ত বিস্তৃত বরফ। পশ্চিমতম প্রান্ত ছুঁয়েছে হিমালয়ের শেষ বিন্দুকে। সে দিক থেকেই বাঁক নিয়ে এই হিমবাহের পূর্ব দিকে এসে শেষ হয়েছে কারাকোরাম। পৃথিবীর দুই দুর্গমতম পর্বতশ্রেণির মাঝে ৭২ কিলোমিটার জুড়ে শুধুই বরফ। সেই সিয়াচেনেই সারাক্ষণ মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে অতন্দ্র প্রহরায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর জওয়ানরা। প্রতি পদক্ষেপে যেন ঘাপটি মেরে অপেক্ষায় মৃত্যু।
পৃথিবীর কয়েকটি দুর্গমতম বিন্দু যদি বেছে নিতে বলা হয়, সিয়াচেন অবশ্যই তার মধ্যে একটি। ভূপ্রাকৃতিক অবস্থান জানলে মনে হয়, পৃথিবী যেন চায় না সিয়াচেনে কেউ পৌঁছক। এই গ্রহের একান্ত, নির্জন প্রান্ত হিসেবেই যেন জন্ম সিয়াচেন হিমবাহের। কিন্তু প্রকৃতি যা-ই চাক, ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতির জেরে সিয়াচেনে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি বাধ্যতামূলক। তাই ভারতীয় সেনাকে প্রকৃতির মারণ খামখেয়ালিপনার সঙ্গে প্রতি মুহূর্তে লড়াই করতে হচ্ছে সিয়াচেনে।
গত ৬ ফেব্রুয়ারি তুষারধসের কবলে পড়েছে ১৯৬০০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত একটি সেনা ছাউনি। কর্তব্যরত ১০ জনই চাপা পড়ে যান বরফের নিচে। ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। এক জনকে জীবন্ত উদ্ধার করা হয়েছে। কিন্তু কোমায় আচ্ছন্ন সেই হনমন্তাপ্পা কোপ্পড বাঁচবেন কি না, সংশয় রয়েছে। তবে সিয়াচেনে এমন বিপদ কিন্তু নতুন নয়। ১৯৮৪ সাল থেকে এই পর্যন্ত প্রায় ১০০০ জওয়ান সিয়াচেনে হতাহত হয়েছেন। একই অবস্থা হয়েছে সেনার ৩০-৪০ জন অফিসারেরও। যুদ্ধ-বিগ্রহের কারণে এই সব মৃত্যু হয়নি। সিয়াচেন হিমবাহের ভয়ঙ্কর প্রকৃতি এই সব মৃত্যুর মূল কারণ। তুষারধস ছাড়াও মারাত্মক তুষারঝড় মাঝে মাঝে আছড়ে পড়ে সিয়াচেনের বুকে। পরিস্থিতি জটিল হলে সেই সব তুষারঝড় কখনও কখনও ১৫ থেকে ২০ দিন ধরে চলতে থাকে। হিমবাহে কর্তব্যরত জওয়ানদের জন্য সে এক ভয়ঙ্কর অভিশাপের মতো। বহু মৃত্যু ডেকে আনে সেই সব ভয়ঙ্কর তুষারঝড়। রয়েছে ক্রিভাসের আতঙ্কও। হিমবাহের কোনও কোনও অংশে মাঝে-মধ্যে গভীর এবং লম্বা ফাটল তৈরি হয়। সেই ফাটল অনেক সময় গ্রাস করে নেয় সর্বস্ব।
এ হেন সিয়াচেনে সেনাবাহিনী মোতায়েন রাখতে প্রতি দিন কত কোটি টাকা খরচ, তা জানলে চমকে উঠতে হয়। কিন্তু খরচ যা-ই হোক, সিয়াচেনে সেনা মোতায়েন করা ছাড়া উপায় নেই ভারতের। ১৯৮৪ সাল থেকেই সেখানে অবস্থান করছে ভারতীয় সেনা। হিমবাহের মধ্যভাগ প্রায় ২৫ কিলোমিটার চওড়া। ১৮ হাজার ফুট উচ্চতার সেই অঞ্চলেই ভারতীয় সেনার বেস ক্যাম্প। এ ছাড়াও সেনা চৌকি রয়েছে হিমবাহের আরও নানা প্রান্তে। পশ্চিমে দুর্গম সালতোরা রিজ্, পূর্বে ভয়ঙ্কর খাড়াই কারাকোরাম আর উত্তরে হিমবাহের সবচেয়ে উঁচু এলাকা— সর্বত্র পাহারায় ভারতীয় সেনা। কারণ সিয়াচেনকে ঘিরে রয়েছে পাকিস্তান আর চিন। অনেকটা নিচু এলাকায় তাদের সেনার অবস্থান বলে হিমবাহের উপরে বসে থাকা ভারতীয় সেনাকে তারা কাবু করতে পারছে না। আর সিয়াচেন দেওয়ালের মতো দাঁড়িয়ে থেকে আড়াল করে রেখেছে কাশ্মীর উপত্যকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে। আড়াল করে রেখেছে লাদাখের নুবরা উপত্যকতাকে। ভারতীয় সেনা সিয়াচেন ছেড়ে চলে এলেই, সেখানে উঠে আসবে পাকিস্তানের সেনা। তার পর অচিরেই দখল নিতে পারবে কাশ্মীর-লাদাখের বিস্তীর্ণ এলাকার।
আরও পড়ুন:
জওয়ান এখন কোমায়, দেখুন বরফের তলা থেকে আশ্চর্য উদ্ধারের ভিডিও
দিনে তাপমাত্রা মাইনাস ২৫ ডিগ্রি। রাতে মাইনাস ৪২ ডিগ্রি। বরফের চাদর কোথায় কত পুরু কেউ জানে না। কত হাজার হাজার বছর ধরে জমে রয়েছে এই বরফ, তারও ঠিকঠাক হিসেব নেই। এমন এক হিমবাহের মাথায় সেনা জওয়ানদের মোতায়েন করার জন্য বহু অত্যাধুনিক সরঞ্জাম এবং পোশাক ব্যবহার করতে হয় সেনাবাহিনীকে। জেনারেটর চালানোর খরচও প্রচুর। তবে প্রতিকূল প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকার জন্য এত রকম সরঞ্জাম জওয়ানদের হাতে আগে ছিল না। জর্জ ফার্নান্ডেজ প্রতিরক্ষা মন্ত্রী থাকাকালীন অবস্থা বদলাতে শুরু করে। জর্জ ছিলেন প্রথম ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী, যিনি সিয়াচেন গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে তিনি জানতে পারেন, অত্যাধুনিক সরঞ্জামের অভাব এবং তাঁর মন্ত্রকের শীর্ষ আমলাদের ঢিলেঢালা মনোভাবে কত কষ্টকর জীবন কাটাতে হচ্ছে সিয়েচেনে মোতায়েন জওয়ানদের। দিল্লি ফিরে মন্ত্রকের ডেপুটি সেক্রেটারিকে সঙ্গে নিয়ে জর্জ ফের হাজির হন সিয়াচেনে। মারাত্মক আবহাওয়ায় অসুস্থ বোধ করতে থাকা ডেপুটি সেক্রেটারিকে সরেজমিনে বুঝিয়ে দেন, কতটা কষ্টে রয়েছেন জওয়ানরা। তার পর থেকে সিয়াচেনে সেনা ক্যাম্পের পরিস্থিতি বদলেছে। সুযোগ-সুবিধা বেড়েছে। তাতে সেনার মনোবল আরও বেড়েছে ঠিকই। কিন্তু তাতে পৃথিবীর সর্বোচ্চ এবং কঠিনতম যুদ্ধক্ষেত্রের ভয়াবহতা কমেনি। প্রকৃতির মারণ খামখেয়াল রুদ্রমূর্তি ধরে মাঝেমধ্যেই সেখানে ওলট-পালট করে দেয় মানুষের সাজানো সব হিসেব।