শহরের স্মৃতিতে পুরনো গাঁধীবাগ, সাপনালার ছবি

সাপের মতো আঁকাবাঁকা জলধারাকে সাপনালা বলে চিনতেন শহরবাসী। সেটির লাগোয়া পার্কে কয়েক মুহূর্তের জন্য রাখা হয়েছিল গাঁধীজির চিতাভস্ম। তাতে সেটির নাম হয় গাঁধীবাগ। সময়ের ঘূর্ণিপাকে দু’টিই পুরনো কৌলিন্য হারিয়েছে।

Advertisement

উত্তম সাহা

শিলচর শেষ আপডেট: ০১ জুন ২০১৫ ০৪:০২
Share:

এখন গাঁধীবাগ। স্বপন রায়ের তোলা ছবি।

সাপের মতো আঁকাবাঁকা জলধারাকে সাপনালা বলে চিনতেন শহরবাসী। সেটির লাগোয়া পার্কে কয়েক মুহূর্তের জন্য রাখা হয়েছিল গাঁধীজির চিতাভস্ম। তাতে সেটির নাম হয় গাঁধীবাগ।

Advertisement

সময়ের ঘূর্ণিপাকে দু’টিই পুরনো কৌলিন্য হারিয়েছে।

শীত-গ্রীষ্মে সাপনালা এখন জলশূন্য হয়ে যায়। বর্ষায় জমে কচুরিপানা। গাঁধীবাগ বদলেছে বিনোদন-পার্কে। টয় ট্রেন, সুরেলা ঝর্না, জাম্বো প্লেয়িং হাউসে বাচ্চাদের দাপাদাপি। টিকিট কাটলে তবেই মেলে প্রবেশাধিকার।

Advertisement

এ সবে ক্ষুব্ধ শিলচরের প্রবীণ বাসিন্দাদের অনেকেই। গাঁধীবাগ নিয়ে তাঁরা ‘নস্ট্যালজিক’। সাপনালার ধারের পার্কে বসে নিখরচায় নিশ্চিন্ত বিশ্রামের স্মৃতি আজও তাঁদের চোখে ভাসে। এক প্রবীণের মন্তব্য, “কম বয়সে সময় পেলেই ছুটতাম গাঁধীবাগে। শিলচরের সব ছেলেই সেখানে যেত তখন। এখন আর কিছুই বাকি নেই।”

এ নিয়ে ভিন্নমতও রয়েছে। তাঁরা বলছেন, “গাঁধীবাগে আগে পাগল আর গাঁজাখোরদের আড্ডা বসত। সাজানোর পর ছবিটা বদলেছে। টিকিট কাটতে হলেও, বাচ্চাদের নিয়ে আরাম করে ঘোরা যায়।”

দীনেন্দ্রনারায়ণ বিশ্বাস, গোবিন্দ দত্ত, কল্যাণ চক্রবর্তীর মতো প্রবীণরা অবশ্য গাঁধীবাগকে পুরনো দিনের মতোই দেখতে চান। দীনেন্দ্রবাবুর কথায়, “গাঁধীবাগে বড় শিল্পীদের নিয়ে বছরে দু’একটা অনুষ্ঠান হতো। মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, আরতি মুখোপাধ্যায়ের মতো শিল্পীরা এসেছিলেন। তা ছাড়া রাজনৈতিক সমাবেশ, মেলাও চলত।” আজকাল গাঁধীবাগের সামনের রাস্তা দিয়ে যাতায়াতই বন্ধ করেছেন অশীতিপর গোবিন্দবাবু। শিলচর মহিলা মহাবিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত ওই গ্রন্থাগারিক বলেন, “সাপনালায় তখন নৌকা চলত। পার্কে হরেক রকম ফুলের বাগান। দেখাশোনা করতেন এক নেপালি মালি।” বৃদ্ধের ক্ষোভ, ১৯৬৪ সালে পুরসভার এক কর্তা গাঁধীবাগের কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, তমাল-সহ অনেক গাছ কেটে দেন। তার কিছু দিন পরে ওই পার্কে সাধারণ মানুষের অবাধ প্রবেশ বন্ধ করা হয়। বছর সত্তরের কল্যাণবাবু বলছেন, “প্রাণের টানে প্রতি দিন বিকেলে ওখানে যেতাম। এখন হয়তো বিনোদনের অনেক ব্যবস্থা হয়েছে। কিন্তু টানটা আর অনুভব করি না।” তাঁদের অভিযোগ, উঠতি বয়সের কিছু ছেলেমেয়ের জন্য পার্কের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। বাচ্চাদের নিয়ে সেখানে যাওয়া যায় না।

তবে গাঁধীবাগের পরিবর্তনকে প্রত্যাশিত বলেছেন শিলচরের অন্য মহল। ১৯৪৬ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত নিয়মিত বন্ধুদের সঙ্গে গাঁধীবাগে যেতেন পরিতোষ চন্দ। তিনি জানালেন, জাতীয় ব্যায়াম বিদ্যালয় ছিল সেখানে। ব্যায়ামের পর সাপনালায় তাঁরা নৌকা চড়তেন। এখন অবশ্য সে সব কিছু নেই। কিন্তু আক্ষেপ করেন না পরিতোষবাবুর। তাঁর কথায়, “ শিশু-কিশোরদের জন্য অনেক কিছু ওখানে হয়েছে। এটা তো ভালই।” প্রবীণ সাংবাদিক পরেশ দত্ত বলছেন, “আগে গাঁধীবাগের পরিসর খুব কম ছিল। দেখার জিনিস বলতে ছিল সাপনালা। খেলাধুলো হতো না তেমন। মেলা দেখতে শুধু ভিড় জমত।” নতুন ধাঁচে তৈরি গাঁধীবাগকে উন্নয়নের প্রতীক হিসেবেই দেখছেন তিনি। পরেশবাবুর কথায়, “পার্কটা নতুন ভাবে সেজেছে। আগে গাছপালার যত্ন করা হতো না, এখন কত পরিচর্যা হচ্ছে।” প্রবীণ শিশু-বিশেষজ্ঞ চন্দ্রশেখর দাস গাঁধীবাগের সৌন্দর্যায়নকে স্বাগত জানালেও, টিকিট চালু করাকে সমর্থন করেন না।

টিকিট নিয়ে সরব আরও অনেকে। গাঁধীবাগের ভিতরে রয়েছে শহিদ স্মৃতিসৌধ। সেতু দিয়ে সাপনালা পেরিয়ে সেখানে যেতে হয়। ১৯৬১ সালের ভাষা-শহিদদের চিতাভস্ম সেই সৌধে রয়েছে। শহরবাসীর একাংশ শ্রদ্ধা জানাতে সেখানে যেতে ইচ্ছুক। কিন্তু টিকিট কেটে পার্ক চত্বরে ঢুকতে হয় বলে, তাঁরা তা করতে পারেন না। সাধারণ মানুষের ক্ষোভের দিকে তাকিয়ে প্রতি সোমবার বিকেলে স্মৃতিসৌধে যাওয়ার জন্য অবাধ প্রবেশের ব্যবস্থা করেছিল পুরসভা। কিন্তু পার্কে ঢোকার আগে প্রবেশপথের নিরাপত্তারক্ষীদের প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে ভেবে কেউ সৌধে যেতে চাইতেন না। পুরসভার বক্তব্য, স্মৃতিসৌধে যাবেন বলে পার্কের ঢোকার পর অনেককে এ দিক ও দিকে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। এ সবের জেরে অবাধ প্রবেশের সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়।

শিলচর পুরসভার শতবর্ষ উপলক্ষে প্রকাশিত গ্রন্থে ঐতিহাসিক দেবব্রত দত্ত লিখেছিলেন— ‘১৯০৪ সালের পূর্বে সাপনালাটা একটা জঙ্গলাকীর্ণ জায়গা ছিল। এর ভেতর দিয়ে শহরের জল বেরিয়ে যেত।... ভাইস চেয়ারম্যান শিবপুর বোটানিক্যাল গার্ডেন থেকে বিনামূল্যে শোভাবর্ধক গাছ এনে সাপনালাতে রোপণ করেন। পরে সাপনালায় ভাল ভাল গাছ বসানো হয় ও দ্বীপের মতো জায়গাটায় বাগান, বসার জন্য বেঞ্চ স্থাপন করা হয়।’ ওই বইয়েই গাঁধীবাগ নিয়ে দেবব্রতবাবু লেখেন— ‘গাঁধীজি নিহত হওয়ার পর ২ ফেব্রুয়ারি পুরসভায় শোকসভা হয়েছিল। অনেক সদস্য সে দিন সভায় গাঁধীজির প্রতি শ্রদ্ধা জানান। চেয়ারম্যান সাপনালার নতুন নামকরণ করেন গাঁধীবাগ। বোর্ড পরে সেই নাম অনুমোদন করে।’

গাঁধীজির নামের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে যে পার্ক, সেখানে কি সকলের সমান অধিকার থাকছে? পুর-কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, সমস্ত সিদ্ধান্ত পুরবোর্ডে আলোচনা করে নেওয়া হয়েছে। টিকিট ব্যবস্থা চালু না থাকলে গাঁধীবাগকে এতটা পরিচ্ছন্ন রাখা যেত না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন