মোদীর সামনেই মুর্দাবাদ, আবেগ-অস্ত্রে ক্ষতি মেরামত

শুরু করার মুহূর্তেই বাধা এসেছিল। ‘মুর্দাবাদ’ স্লোগান উঠেছিল দর্শকাসন থেকে। বিচলিত হননি নরেন্দ্র মোদী। খানিক থমকে ‘ট্রেডমার্ক’ ভঙ্গিতেই তিনি শুরু করেছিলেন বক্তৃতা।

Advertisement

অনমিত্র সেনগুপ্ত

হায়দরাবাদ শেষ আপডেট: ২৩ জানুয়ারি ২০১৬ ০৩:৩২
Share:

ই-রিকশায় সওয়ার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সহযাত্রী রাজনাথ সিংহ। লখনউয়ের একটি অনুষ্ঠানে। ছবি: পিটিআই।

শুরু করার মুহূর্তেই বাধা এসেছিল। ‘মুর্দাবাদ’ স্লোগান উঠেছিল দর্শকাসন থেকে। বিচলিত হননি নরেন্দ্র মোদী। খানিক থমকে ‘ট্রেডমার্ক’ ভঙ্গিতেই তিনি শুরু করেছিলেন বক্তৃতা।

Advertisement

দেশে কী ভাবে তারুণ্যের জোয়ার এসেছে, লখনউয়ের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে সেই কথাই বলছিলেন প্রধান অতিথি মোদী। সেই প্রসঙ্গেই হঠাৎ বললেন, ‘‘এমন একটা সময়ে কি না শুনতে হয় যে, আমারই দেশের এক তরুণ রোহিত আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে!’’

তার পর থমকে গেলেন। এক-দুই-তিন করে পেরোচ্ছে সেকেন্ডের কাঁটা। গোটা প্রেক্ষাগৃহে এক-একটা নিঃশ্বাসের শব্দও যেন শোনা যায়। টিভির পর্দায় তখনই দেখা গেল, চেপে রাখা ঠোঁটদু’টো কাঁপছে প্রধানমন্ত্রীর! চশমার কাচের আড়ালে পিটপিট করছে চোখদু’টো। ঠিক চব্বিশ সেকেন্ড বাদে পরের বাক্যটা বেরোল, ‘‘ওঁর পরিবারকে কোন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে!’’ ফের নৈঃশব্দ। এ বার ১৮ সেকেন্ড। তার পর ফের কথা, ‘‘ভারতমাতা তাঁর এক সন্তানকে হারালেন।’’

Advertisement

হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রোহিত ভেমুলার আত্মহত্যা ঘিরে দেশজোড়া রাজনৈতিক চাপানউতোরের প্রেক্ষাপটে সম্ভবত সব চেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ কথাগুলো এর পরেই বললেন মোদী— ‘‘কারণ অপনে জগা পর হোঙ্গে, রাজনীতি অপনি জগা পে হোগা। লেকিন সচ্চা ইয়ে হ্যায় কি, মা-নে এক লাল খোয়া! ইস কী পীড়া ম্যায় মেহসুস করতা হুঁ।’’ অর্থাৎ, সন্তানহারা মায়ের কষ্ট আমি বুঝি। এটা রাজনীতির জায়গা নয়।

গলায় ফাঁস লাগানো রোহিতের দেহটা উদ্ধার হয়েছিল পাঁচ দিন আগে। এই পাঁচ দিনে বিজেপি-বিরোধী প্রায় সমস্ত রাজনৈতিক দলের নেতারা ছুটে গিয়েছেন হায়দরাবাদের ক্যাম্পাসে। প্রধানমন্ত্রী কেন নীরব— ছাত্রদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন তাঁরাও। দাদরি হত্যাকাণ্ডের সময় মোদী যে আট দিন কেটে যাওয়ার পরে মুখ খুলেছিলেন, সেই কথাও মনে করিয়ে দিয়েছিলেন কেউ কেউ। আর ঠিক এই সময়টাতেই বিরোধীদের তোপ দাগতে গিয়ে উল্টে বিজেপিকে বিপাকে ফেলছিলেন মোদীর সতীর্থ মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি-সহ অন্যরা। যা নিয়ে বিরক্ত ছিলেন মোদী নিজেও।

অনেকেই বলছেন, এমন সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী নিজেই আজ দলকে উদ্ধার করতে এগিয়ে এলেন। এবং সেই কাজে তাঁকে কিছুটা সফল তো বলাই চলে। এক দিকে রোহিতের কথা বলতে গিয়ে তিনি কিছুটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছেন ঠিকই, কিন্তু সেই আবেগ সামালও দিয়েছেন। আবার বক্তৃতার গোড়ায় নিজের বিরুদ্ধে স্লোগান শুনেও মাথা ঠান্ডা রেখেছেন। দলের এক শীর্ষ নেতার কথায়, ‘‘স্মৃতির মতো অনভিজ্ঞদের এগুলো দেখে শেখা উচিত।’’

মোদীর বক্তৃতা শুরুর মুখেই প্রেক্ষাগৃহে স্লোগান ওঠে, ‘‘মোদী মুর্দাবাদ! মোদী গো ব্যাক! ইনকিলাব জিন্দাবাদ!’’ দেখা যায়, সমাবর্তনের উত্তরীয় পরা দুই পড়ুয়ার সঙ্গে ধস্তাধস্তি চলছে পুলিশের। স্লোগান বন্ধ করতে তাদের মুখ চেপে ধরেছে পুলিশ। অকুস্থলের নামটাও গুরুত্বপূর্ণ— বাবাসাহেব ভীমরাও অম্বেডকর বিশ্ববিদ্যালয়! হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ছাত্র সংগঠনের সদস্য ছিলেন রোহিত, সেটির নাম ‘অম্বেডকর স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন’ (এএসএ)। মোদীর দল বিজেপির ছাত্র সংগঠন এবিভিপি-র সদস্যদের নিগ্রহের দায়ে সাসপেন্ড হয়েছিলেন রোহিত-সহ সেই সংগঠনেরই পাঁচ জন নেতা!

এবং এমন স্লোগান শুনেও আজ বক্তৃতায় একটিও কড়া কথা বলেননি মোদী। উল্টে অম্বেডকরের কথা বলেছেন। বলেছেন, চরম অপমানের মুখেও কী ভাবে ধৈর্য না হারিয়ে নিজের কর্তব্য করে যেতেন ভারতীয় সংবিধানের ভবিষ্যৎ প্রাণপুরুষ। অনেকের মতে, রোহিত-আবেগ সামাল দেওয়ার পাশাপাশি বিজেপির ‘দলিত-বিরোধী’ ভাবমূর্তি ঘোচানোটাও মাথাব্যথা ছিল মোদীর। বাবাসাহেবের কথা বলে আজ সেই প্রয়াসই করলেন তিনি।

এক দিকে লখনউয়ে মোদী, অন্য দিকে আজ দিল্লি থেকে সক্রিয় হন স্মৃতি। ফোনে কথা বলেন রোহিতের মা রাধিকা ভেমুলার সঙ্গে। আশ্বাস দেন, গোটা ঘটনাটি খতিয়ে দেখার জন্য বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠন হচ্ছে। তিন মাসে রিপোর্ট জমা দেবে সেই কমিশন। বিজেপি শিবিরের আশা, ওই সময়ের মধ্যে প্রাথমিক উত্তেজনা থিতিয়ে আসবে।

আজ মোদীর মন্তব্যকে স্বাগত জানিয়েছেন রোহিতের সহপাঠীরা। তবে তাঁরা সাফ বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আপ্পা রাওয়ের পদত্যাগ, কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রী বন্দারু দত্তাত্রেয় এবং কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়নমন্ত্রী স্মৃতি ইরানিকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা থেকে সরানোর মতো দাবিগুলি থেকে সরে আসছে না এএসএ। রোহিতের সাত সহপাঠী আজও অনশন জারি রেখেছেন। দিনভর চলছে অবস্থান বিক্ষোভ। ছাত্রদের সমর্থনে পাশে দাঁড়িয়েছে সারা ভারত তফসিলি জাতি ও উপজাতি সংগঠন। রাজ্যসভার সিপিএম সাংসদ টি এন সীমা ঘটনার যথোচিত তদন্তের আর্জি জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটর, রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কাছে। হায়দরাবাদের মতো অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতেও কী ভাবে দলিত ছাত্ররা বঞ্চনার শিকার হন, সে বিষয়েও বিস্তারিত জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতিকে।

এরই মধ্যে আজ আবার বিতর্ক বাড়িয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এক দিকে রোহিতের পরিবারকে আট লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু পাশাপাশিই রোহিতের চার বন্ধুর সাসপেনশন ‘শর্তসাপেক্ষে’ প্রত্যাহার করা হয়েছে বলে মন্তব্য করে বসেছেন উপাচার্য। এর ফলে পরিস্থিতি নতুন করে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। উপাচার্যের পক্ষ থেকে দেখা করার প্রস্তাব বাতিল করে দেন রোহিতের মা রাধিকা।

বিশ্ববিদ্যালয়ে অচলাবস্থায় পড়ুয়াদের সেমেস্টার পিছিয়ে যাবে, সেই আশঙ্কায় গত কাল শিক্ষকদের পক্ষ থেকে উপাচার্যকে ছাত্রদের সঙ্গে আলোচনায় বসার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বিক্ষোভ না ওঠা পর্যন্ত তিনি কোনও আলোচনায় যাবেন না বলে অনড় থাকেন উপাচার্য। তার জেরে ক্ষুব্ধ শিক্ষকদের একাংশ আজ প্রকাশ্যে বিক্ষোভকারীদের সমর্থন করেছেন। সূত্রের খবর, শিক্ষকদেরও এই মনোভাব দেখে আজ শেষমেশ বিকেলে ছাত্রদের সঙ্গে বৈঠক করার কথা ভেবেছিলেন উপাচার্য আপ্পা রাও। কিন্তু ছাত্ররা না রাজি হওয়ায় ভেস্তে যায় সেই উদ্যোগও।

অসন্তোষ আরও রয়েছে। ছাত্রদের সঙ্গে দেখা করতে ইতিমধ্যেই দিল্লি থেকে উড়ে এসেছেন রাহুল গাঁধী, অরবিন্দ কেজরীবালের মতো নেতারা। এসেছেন সীতারাম ইয়েচুরি, ডেরেক ও’ ব্রায়েন। ত্রিপুরা থেকে আসার কথা রয়েছে মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারের। কিন্তু তেলঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রীর কে চন্দ্রশেখর রাও এখনও বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটনা নিয়ে চুপ। বিশ্ববিদ্যালয়ে পা দেওয়া তো দূর, রোহিতের পরিবারের সঙ্গেও দেখা করেননি। তাতে অসন্তুষ্ট রোহিতের বন্ধুরা। তাঁদের অনেকের অভিযোগ, উচ্চবর্ণের ভোটের দিকে তাকিয়েই নীরব রয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। ছাড় পাননি প্রতিবেশী রাজ্য অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নায়ডু। বন্ধুরা বলছেন, হাজার হোক, রোহিত তো অন্ধ্রপ্রদেশের গুন্টুর জেলারই ছেলে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন