বিজেপি-তে ক্ষোভ বাড়ছে, বিড়ম্বনার কারণ হয়ে উঠছেন স্বামী

কথা ছিল রাজ্যসভার সদস্য হয়ে কপ্টার ঘুষ-কাণ্ডে সনিয়া গাঁধীকে আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য করবেন সুব্রক্ষ্মণ্যম স্বামী। কিন্তু প্রকাশ্যে দিল্লির এক সাপ্তাহিককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অরুণ জেটলিকে সরিয়ে নিজের অর্থমন্ত্রী হওয়ার ইচ্ছা জানিয়ে দলের মধ্যেই বিরাট গোলমাল বাঁধিয়ে দিয়েছেন তিনি।

Advertisement

জয়ন্ত ঘোষাল

দিল্লি শেষ আপডেট: ১৩ মে ২০১৬ ১৭:৪৩
Share:

কথা ছিল রাজ্যসভার সদস্য হয়ে কপ্টার ঘুষ-কাণ্ডে সনিয়া গাঁধীকে আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য করবেন সুব্রক্ষ্মণ্যম স্বামী। কিন্তু প্রকাশ্যে দিল্লির এক সাপ্তাহিককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অরুণ জেটলিকে সরিয়ে নিজের অর্থমন্ত্রী হওয়ার ইচ্ছা জানিয়ে দলের মধ্যেই বিরাট গোলমাল বাঁধিয়ে দিয়েছেন তিনি। এখানেই শেষ নয়, এ কথাও তিনি জানিয়েছেন, বিগত লোকসভা নির্বাচনে নয়াদিল্লির আসন থেকে তাঁকে লোকসভার প্রার্থী করার কথা হয়েছিল। কিন্তু অরুণ জেটলি, তিনি পঞ্জাবি নন বলে তাঁকে টিকিট দিতে রাজি হননি।

Advertisement

প্রকাশ্যে স্বামীর বিরুদ্ধে একটি কথাও জানাননি অরুণ। কিন্তু বিজেপি সূত্রে জানা গেল, স্বামীর বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী অরুণের সঙ্গে কথা বলেছেন। দলের পক্ষ থেকে স্বামীকে সতর্ক করা হয়েছে। জেটলি শুধু নন, নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহ স্বামীকে দিয়ে সনিয়া রাহুলের বিরুদ্ধে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার রাজনীতি করতে চাইলেও রবিশঙ্কর থেকে শুরু করে রাজ্যসভায় বিজেপি-র সংসদীয় দলের উপনেতা মুখতার আব্বাস নকভি পর্যন্ত স্বামীর উপর রেগে আগুন। রাজ্যসভার সদস্য হিসাবে শপথ গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গেই তিনি কোনও অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়াই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যান। সেটাও সাংবাদিকদের সবিস্তার জানিয়েছেন যে, তিনি যে কোনও সময়ে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়াই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে পারেন। তার কারণ, মোদী তাঁর দীর্ঘদিনের বন্ধু।

আরও পড়ুন: বাসের জানলায় বসে কানে ফোন, হাত গেল তরুণীর

Advertisement

আরবিআই গভর্নর রঘুরাম রাজনকে প্রকাশ্যে আক্রমণ করার পাশাপাশি স্বামী প্রধানমন্ত্রীকে একটি চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রক আর্থিক সঙ্কটমোচনে ব্যর্থ। এ ব্যাপারে যাবতীয় যুক্তি প্রদর্শন করেই চিঠি দিয়েছেন তিনি। এই চিঠিটিও কার্যত অরুণের প্রতি তীব্র অনাস্থায় পর্যবসিত। কংগ্রেসের অভিযোগে গলা মিলিয়ে তিনিও বলেছেন, বিদেশ থেকে কালো টাকা আনতে ব্যর্থ এই সরকার। আরএসএস-এরই কিছু নেতা বলতে শুরু করেছেন, ২০০০ সালে এই স্বামী কিন্তু আরএসএস-কে ফাসিস্ত বলেছিলেন। ন্যাশনাল হেরাল্ড মামলায় মোদী সে রকম আগ্রহ দেখাচ্ছেন না এমন অভিযোগও তিনি করেছিলেন। এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের কর্তা কংগ্রেসের ঘনিষ্ঠ বলে প্রধানমন্ত্রী উপর চাপ তৈরি করে তাঁকে সরাতে বাধ্য করেছেন এই স্বামী। কাজেই এই ধরনের অনিয়ন্ত্রিত মিসাইলকে সনিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে গিয়ে খোদ নরেন্দ্র মোদী বিপদে পড়েন কি না— এমন আশঙ্কা দেখা দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ মহলেই।

স্বামী ছাড়া আরও পাঁচ জন সংসদ সদস্য রাষ্ট্রপতি মনোনীত প্রার্থী হিসাবে শপথ নিয়েছেন। কিন্তু পঞ্জাবের নভজ্যোৎ সিংহ সিধু উড়ান মিস করায় প্রথম দিন আসতে পারেননি। তখন নকভি স্বামী-সহ সকল সদস্যকে জানান, সেক্রেটারি জেনারেলের কাছে মনোনীত সদস্যরা যে ফর্ম জমা দেবেন সেটা তাড়াহুড়ো করে জমা না দিয়ে ধীরে ধীরে একসঙ্গে সকলে মিলে জমা দেবেন। স্বামী বলেন, ‘‘আমি তো জমা দিয়ে দিয়েছি। পার্টি প্রেসিডেন্ট আমাকে আজকে জমা দিতে বলেছেন।’’ উপনেতা নকভি তখন ফোন করেন দলের সভাপতিকে। অমিত শাহ তখন বলেন, ‘‘ও তো অনুমতি চেয়েছিল। আমি দিয়ে দিয়েছি।’’ স্বামীর যুক্তি ছিল, ফর্ম জমা দিলে সভায় আসন চিহ্নিত হবে। এবং তিনি অগুস্তা কপ্টারের কেলেঙ্কারি উত্থাপন করবেন। তবে, এমনকী দলীয় নেতা অরুণ জেটলির সঙ্গেও তিনি বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেননি।

জেটলির সঙ্গে স্বামীর সম্পর্ক চিরকালই তিক্ত। বিজেপি-র বহু নেতা এখনও মনে করেন, স্বামী এবং তার সঙ্গে সিধুকে (অরুণের জন্য যাঁকে অমৃসতরের আসনটি ছেড়ে দিতে হয়েছিল বলে যিনি আজও ক্ষিপ্ত) রাজ্যসভায় নিয়ে এসে অরুণ জেটলির রাজনৈতিক গুরুত্বকে একটু খর্ব করতে চেয়েছেন। স্বামীর এই উদগ্র সনিয়া বিরোধিতার সমর্থক নন অরুণ জেটলি। তিনি দলীয় সাংসদদের বলেছেন, বিজেপি এবং আরএসএস সমর্থকদের মধ্যে গাঁধী পরিবার-বিরোধী একটা ভোট ব্যাঙ্ক আছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত যখন কাগজে-কলমে কোনও প্রমাণ নেই, তখন এটা নিয়ে নিচুতলায় বিজেপি কর্মীরা চিৎকার করতে পারেন, কিন্তু সংসদের ভিতরে এমন কিছু নথিভুক্ত করা উচিত নয়, আইনের দিক থেকে যার সত্যতা প্রতিষ্ঠা করা কঠিন। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত হতে পারে, কিন্তু তদন্তের আগেই স্বামী শেষ কথা বলে দিচ্ছেন।

স্বামীকে নিয়ে সমস্যা কিন্তু নতুন নয়। অটলবিহারী বাজপেয়ীর সঙ্গে স্বামীর অহি-নকুল সম্পর্ক ছিল। তখনও আরএসএস-এর একটা অংশের চাপে স্বামীকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী করতে হয়েছিল। আইনমন্ত্রী হয়ে তিনি বিচারব্যবস্থায় এমন সব কাণ্ড শুরু করে দিয়েছিলেন এবং এমন সব বিবৃতি দিতে শুরু করেন যে বাজপেয়ী বিপদে পড়ে গিয়েছিলেন। স্বামী খুবই ভাল বক্তা, এত লোকের বিরুদ্ধে সক্রিয় রাজনীতি করা সত্ত্বেও কেউ স্বামীকে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রমাণ করতে পারেনি। উচ্চশিক্ষিত, সত্তরের দশকে আন্দোলন করে সনিয়াকে বাধ্য করেছিলেন বিমা সংস্থা থেকে ইস্তফা দিতে। জয়ললিতা এবং এ রাজার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে সফল হয়েছিলেন। এ বারেও উচ্চাকাঙ্খী স্বামীকে রাজ্যসভায় মনোনয়নের ব্যাপারে মোহন ভাগবতের পূর্ণ সমর্থন ছিল। আরএসএস-কে খুশি রাখার জন্য তিনি নতুন করে রামমন্দির আন্দোলন শুরু করেছেন। উগ্র হিন্দুত্বের উপর বইও লিখেছেন তিনি।

রাজ্যসভা সদস্য হতে না হতেই শুধু রঘুরাম রাজনকে আক্রমণ করা নয়, তাঁকে ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক এবং আইএমএফ-এর লোক বলে দেওয়ায় খোদ প্রধানমন্ত্রী অস্বস্তিতে। প্রধানমন্ত্রী তাঁকে ব্রিকস ব্যাঙ্কের প্রধান হতে বলেছিলেন প্রথমে। তখন স্বামী বলে দেন, বিদেশে কোনও পদে তিনি যেতে রাজি নন। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য করার কথা হয়েছিল। তাতেও তিনি রাজি হননি। কারণ তাঁর বক্তব্য, সরকারের এক জন যুগ্ম সচিবও উপাচার্যকে ঘর থেকে বের করে দিতে পারেন! অমন পদ নিয়ে লাভ কী? রঘু রাজনকে সরিয়ে আরবিআই-এর গভর্নর তাঁকে করলে রজি হবেন কি না, এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘‘আমি রাজনৈতিক ব্যক্তি। কোনও অরাজনৈতিক পদ আমি নেব না।’’ কিন্তু জেটলিকে সরিয়ে অর্থমন্ত্রী করার ব্যাপারে তিনি রাজি। এ ব্যাপারে তাঁর বক্তব্য, ‘‘নিশ্চয়ই আমি এই পদ নিতে রাজি। কারণ এটা রাজনৈতিক পদ।’’ আর ব্রিকস ব্যাঙ্ক সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘‘চিনকে আমার চেয়ে বেশি কেউ চেনে না। ওই ব্যাঙ্ক কোনও দিন চালু হবে না।’’

ধীরে ধীরে স্বামীকে নিয়ে ক্ষোভ বাড়ছে। তামিলনাড়ুর চিদম্বরম শুধু নন, মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতাও ঘোরতর স্বামী বিরোধী। দলের প্রবীণ নেতারা, যাঁদের মার্গদর্শকমণ্ডলীর সদস্য করে দেওয়া হল বয়সের কারণে, তাঁরা বলছেন, স্বামীরও বয়স এখন ৭৬ বছর। তাঁর ক্ষেত্রে কেন ব্যতিক্রম হবে? শেষ পর্যন্ত তাই স্বামীকে নিয়ে মোদী এবং অমিত শাহ কী করবেন সেটাই এখন দেখার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন