রোগ সারাতে শিশুদের পেটে শিকের ছেঁকা

নাভির পাশে গরম লোহার সরু শিকের ছেঁকায় তখন তারস্বরে চিৎকার করছিল একরত্তি শিশুগুলি। কিন্তু তাতে মন গলছিল না মা-বাবাদেরও! সন্তানদের এ ভাবেই পেটের রোগ থেকে বাঁচার ‘দাওয়াই’ দিতে ব্যস্ত ছিলেন সকলে। নাভির চার পাশে পাঁচ বার গরমে লাল হয়ে ওঠা লোহার শিকের ছোঁয়া দেওয়ার পরই রেহাই মিলছিল অসহায় শিশুগুলির।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

রাঁচি শেষ আপডেট: ১৮ জানুয়ারি ২০১৬ ০২:৫৬
Share:

পুরোহিতের বাড়িতে সন্তানদের নিয়ে ভিড়। ছবি :পার্থ চক্রবর্তী।

নাভির পাশে গরম লোহার সরু শিকের ছেঁকায় তখন তারস্বরে চিৎকার করছিল একরত্তি শিশুগুলি। কিন্তু তাতে মন গলছিল না মা-বাবাদেরও!

Advertisement

সন্তানদের এ ভাবেই পেটের রোগ থেকে বাঁচার ‘দাওয়াই’ দিতে ব্যস্ত ছিলেন সকলে। নাভির চার পাশে পাঁচ বার গরমে লাল হয়ে ওঠা লোহার শিকের ছোঁয়া দেওয়ার পরই রেহাই মিলছিল অসহায় শিশুগুলির।

কোনও শাস্তি নয়, সন্তানের মঙ্গল কামনাতেই বছরের পর পর বছর এই রীতি চলে আসছে জামশেদপুর লাগোয়া সাঁওতাল গ্রাম করণ্ডিতে। সেখানকার বাসিন্দাদের বিশ্বাস— শিশুদের পেটে গরম লোহার শিকের ছেঁকা দিলে পেটের রোগ থেকে আজীবন মুক্তি পাওয়া যাবে। শরীর-স্বাস্থ্যও ভাল থাকবে।

Advertisement

মকর সংক্রান্তির পরের দিন গ্রামের পুরোহিতরা শিশুদের সেই ‘দাওয়াই’ দেন। সাঁওতালি ভাষায় এর প্রথার নাম ‘চিরিদাগ’। এ রকম কুসংস্কারের কথা জানে প্রশাসনও। তা রুখতে উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। কিন্তু চিরিদাগ পুরোপুরি বন্ধ হয়নি।

এ বছরও করণ্ডির পুরোহিত ছটু সর্দারের বাড়িতে ভিড় জমেছিল সকাল থেকেই। দীনেশ মুর্মূ, বাবলু সোরেনরা সন্তানদের নিয়ে হাজির হয়েছিলেন। কারও বয়স দেড় বছর, কারও বা এক। গ্রামবাসীরা জানান, জন্মের পর ২২ দিন পর্যন্ত চিরিদাগ দেওয়া যায় না।

ছটু সর্দারের উঠোনে জ্বলছিল কাঠ, ঘুঁটের আগুন। পাশেই রাখা লোহার শিক। সেটিকে আগুনে সেঁকে নেওয়ার আগে পুরোহিত একটি পাত্রে রাখা সরষের তেল ঘষে দিচ্ছিলেন শিশুদের নাভির চারপাশে। গরমে শিকটা লালচে হলেই নাভির চার পাশে চেপে ধরছিলেন। যন্ত্রণায় শিশুরা চিৎকার করে কেঁদে উঠছিল।

সন্তানকে নিয়ে পুরোহিতের বাড়িতে হাজির হয়েছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা দীনেশ মুর্মূ। তিনি বলেন, “এটা অনেক বছরের প্রথা। আমিও চিরিদাগ দিয়েছি। এতে বাচ্চাদের পেটের রোগ জীবনে কখনও হয় না।” আপনার কী কখনও পেটের রোগ হয়নি? হাসিমুখেই দীনেশের জবাব, “অত কিছু বলতে পারব না। এটা করলে বাচ্চার মঙ্গল হয়।” একই কথা বললেন বাবলু সোরেনও।

কিন্তু চিরিদাগ যে কুসংস্কার তা কার্যত মেনেছেন পুরোহিত ছটু সর্দার। তিনি বলেন, “এটা কুসংস্কার হলেও যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। আমার বাবাও শিশুদের চিরিদাগ দিতেন। ১৫-২০ বছর আগে মকর সংক্রান্তির পরের দিন আমার বাড়িতে শ’খানেক শিশু আসত।” তবে এ বার তিনি ৩০-৩৫ জন শিশুকে চিরিদাগ দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন।

কেন বন্ধ করা যাচ্ছে না এই কুসংস্কার? ঝাড়খণ্ডের সমাজকর্মী দয়াময়ী বড়াল বলেন, “আগের থেকে ওই প্রথা অনেকটাই কমেছে। আমরা গ্রামে গ্রামে গিয়ে প্রচার করছি। সবাইকে বলছি শিশুদের নিয়ে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেতে। সেখানে স্বাস্থ্যকর্মীরা টিকা দেবেন। সেটাই শিশুদের রোগ থেকে বাঁচিয়ে রাখবে।” জামশেদপুরের মহকুমা শাসক সুরজ কুমার বলেন, “এ রকম কুসংস্কারের কথা শুনলে শিউরে উঠতে হয়। অভিযোগ না হলেও কোন কোন এলাকায় এখনও ওই প্রথা চলছে তা জেনে উপযুক্ত পদক্ষেপ করা হবে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন