পঞ্চায়েতে আবশ্যিক শিক্ষা, রাজ্য নারাজ

শিক্ষা আনে চেতনা। সেই চেতনা বাড়ায় কাজ করার দক্ষতা। ন্যূনতম শিক্ষাই ভাল-মন্দ, ঠিক-ভুলের বিচার করে কাজ করার ক্ষমতা জোগায়— এই পর্যবেক্ষণ সুপ্রিম কোর্টের।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

কলকাতা ও নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০১৫ ০৩:১৬
Share:

শিক্ষা আনে চেতনা। সেই চেতনা বাড়ায় কাজ করার দক্ষতা। ন্যূনতম শিক্ষাই ভাল-মন্দ, ঠিক-ভুলের বিচার করে কাজ করার ক্ষমতা জোগায়— এই পর্যবেক্ষণ সুপ্রিম কোর্টের। তাই ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের প্রার্থীদের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা বাধ্যতামূলক বলে হরিয়ানা সরকার সম্প্রতি যে আইন করেছে, তাকে পূর্ণ সমর্থন করেছে সর্বোচ্চ আদালত।

Advertisement

হরিয়ানার আইন এবং তা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের মতামত জেনেও এই নিয়ে কিছুই ভাবছে না এ রাজ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। বরং তারা মনে করে, ওই আইনকে ‘সমর্থন’ দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট সংবিধান বহির্ভূত কাজ করল। রাজ্যের পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী এবং শাসক দলের অন্যতম শীর্ষ নেতা সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের মতে, ‘‘কোনও রাজ্য সরকার এমন আইন করতে পারে না, যা সংবিধান বিরোধী।’’ যদিও সংবিধানে কোথাও বলা হয়নি যে প্রার্থীদের ন্যূনতম যোগ্যতামান থাকতে পারবে না। বরং সংবিধানে, পঞ্চায়েতিরাজ সংক্রান্ত ২৪৩এফ ধারার ১(বি) উপধারায় সদস্য হওয়ার ক্ষেত্রে বা সদস্য পদ খারিজের ক্ষেত্রে যোগ্যতা-অযোগ্যতার প্রশ্নে রাজ্য বিধানসভাকে আইন প্রণয়নের অধিকারই দেওয়া হয়েছে। হরিয়ানা সরকারের ওই আইন সংবিধান-বিরোধী, তা সুপ্রিম কোর্টও মনে করে না। তারা বলেছে, ভোট দেওয়া ও ভোটে দাঁড়ানো দেশের নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। তবে আইনসভা তা নিয়ন্ত্রণও করতে পারে।

আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনে প্রার্থীদের শিক্ষাগত যোগ্যতাকে বাধ্যতামূলক করে আইন সংশোধন করেছে হরিয়ানা সরকার। সেই আইনকে চ্যালেঞ্জ করে কয়েক জন মহিলা প্রার্থী সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেন। বৃহস্পতিবার সেই আবেদন খারিজ করে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি জে চেলামেশ্বর এবং বিচারপতি অভয় মনোহর সাপ্রের ডিভিশন বেঞ্চ। হরিয়ানার এই সংশোধিত আইন অনুযায়ী, পঞ্চায়েতে সাধারণ প্রার্থীদের দশম শ্রেণি উত্তীর্ণ, মহিলা ও দলিত পুরুষ প্রার্থীদের অষ্টম শ্রেণি উত্তীর্ণ এবং দলিত মহিলা প্রার্থীদের পঞ্চম শ্রেণি পাস হতেই হবে। এ ছাড়া, প্রার্থীদের বাড়িতে স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার থাকা বাধ্যতামূলক। প্রার্থী হতে গেলে বাড়ির বিদ্যুতের বিল ও গ্রামীণ সমবায় ব্যাঙ্কে ঋণ বাকি থাকাও চলবে না। বিজেপি শাসিত হরিয়ানার আগে রাজস্থানের বিজেপি সরকারও রাজ্য পঞ্চায়েত নির্বাচনে প্রার্থীদের জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতাকে আবশ্যিক করে আইন প্রণয়ন করেছে।

Advertisement


সবিস্তারে দেখতে ক্লিক করুন...

সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণকে কড়া ভাষায় সমালোচনা করেছে সিপিএম-সহ বাম সংগঠনগুলি। বস্তুত, বাম সংগঠনগুলি সুপ্রিম কোর্টে রিভিউ পিটিশন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। রাজ্যের বিরোধী দলনেতা তথা প্রাক্তন পঞ্চায়েত মন্ত্রী সূর্যকান্ত মিশ্র বলেছেন, ‘‘এ দেশের গ্রামীণ জনসংখ্যার একশো শতাংশ এখনও শিক্ষিত নন। নানা রকম শর্ত চাপিয়ে জনপ্রতিনিধিত্ব করার অধিকারে হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়। কামরাজের (‘কামরাজ প্ল্যান’-এর জনক, প্রাক্তন কংগ্রেস সভাপতি) কথা ভারতীয় রাজনীতি মনে রেখেছে। কিন্তু তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে কেউ কোনও দিন প্রশ্ন তোলেনি।’’

বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অবশ্য বক্তব্য, রাজ্যের এক্তিয়ার আছে এ ব্যাপারে আইন করার। হরিয়ানা প্রথম রাজ্য নয়, যেখানে এমন আইন হয়েছে। এই আইন নির্বাচনী প্রক্রিয়া সংস্কারের ক্ষেত্রে একটি বড় পদক্ষেপ। এ রাজ্যে দলের একমাত্র বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘‘শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকায় বা সামান্য যোগ্যতার কারণে জনপ্রতিনিধিরা অনেক সময় প্রশাসন ও অন্য কাজে অসহায় হয়ে পড়েন।’’ কংগ্রেসের মানস ভুঁইয়া আরও এক ধাপ এগিয়ে সওয়াল করেছেন, ‘‘ছাত্রজীবন থেকে শুনে আসছি রাজনীতি নোংরা। ভাল শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা রাজনীতিতে না-এলে গাল কাটা, কান কাটা মস্তানরাই রাজনীতিতে দাপিয়ে বেড়াবে। তাই সাংসদ, বিধায়ক থেকে গ্রাম পঞ্চায়েত সদস্য, সব স্তরেই জনপ্রতিনিধিদের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকা উচিত।’’ যদিও মানসবাবুর দলের কেন্দ্রীয় মুখপাত্র তথা সংবিধান বিশেষজ্ঞ অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি উল্টো কথা বলছেন। এর আগে যখন রাজস্থান সরকার প্রার্থীপদ অভিলাষীদের জন্য বাধ্যতামূলক ন্যূনতম যোগ্যতা আইন তৈরি করে, তখনও তার বিরোধিতা করেছেন সিঙ্ঘভি। আজও এর বিরোধিতা করেছেন তিনি। সিঙ্ঘভি মনে করেন, এটা আসলে বিজেপির বৃহত্তর চক্রান্তেরই অঙ্গ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কংগ্রেস নেতা বিষয়টিকে একেবারে অন্য দিক থেকে দেখছেন। তাঁর কথায়, ‘‘এর পিছনে আরএসএস-এর হাত রয়েছে। বর্ণহিন্দু রাজনীতির প্রবক্তারা সেই পথেই দেশকে নিয়ে যেতে চাইছেন।’’

তবে পরোক্ষে ‘যাঁদের’ নিয়ে এই আইনি চাপান-উতোর বা উচিত-অনুচিতের টানাপড়েন, সেই পঞ্চায়েত স্তরের জনপ্রতিনিধিদের অনেকেই কিন্তু দলমতের ঊর্ধ্বে মত দিয়েছেন। যে সিপিএম এই রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ পিটিশন দাখিল করার কথা ঘোষণা করেছে, সেই সিপিএমেরই এক মহিলা পঞ্চায়েত প্রধানের বক্তব্য ঠিক উল্টো। হুগলির শ্রীরামপুর-উত্তরপাড়া ব্লকের রঘুনাথপুর পঞ্চায়েতের প্রধান, সিপিএমের পার্বতী মণ্ডলের মতে, পঞ্চায়েতে কাজের বহর বেড়েছে। রোজ রোজ নতুন অর্ডার বেরোচ্ছে, প্রকল্পের কাজ দেখভাল হচ্ছে। ফোন, এসএমএস বা ই-মেলে অনেক কাজ হচ্ছে। তাঁর বক্তব্য, ‘‘নিজেরা যদি ওয়াকিবহাল না-থাকি, তা হলে এই সব কাজে অন্যদের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে। তাতে ভুল পথে চালিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ফলে ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকাটা জরুরি।’’ ভোটে দাঁড়াতে গেলে বাড়িতে শৌচাগার থাকা বা কর মেটানোর পক্ষেও সওয়াল করেন পার্বতীদেবী।

দিল্লির আকবর রোড কী বলছে তা নিয়ে ভাবিত নন কংগ্রেস পরিচালিত সবং পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি অমল পণ্ডা। তাঁর সাফ কথা, “পঞ্চায়েতের প্রার্থী হতে গেলে ন্যূনতম কিছু যোগ্যতা থাকা প্রয়োজন। শুধু পঞ্চায়েত সদস্য নয়, কংগ্রেসের এক জন কর্মী হিসেবেও সুপ্রিম কোর্টের এই নির্দেশকে স্বাগত জানাচ্ছি।” দলের পঞ্চায়েত মন্ত্রী তথা অন্যতম শীর্ষ নেতার সঙ্গে একমত নন তৃণমূলের কোচবিহার জেলা পরিষদের সভাধিপতি পুষ্পিতা ডাকুয়া। তিনি বলেন, “পঞ্চায়েতে প্রার্থী হতে গেলে শিক্ষিত হওয়া প্রয়োজন। না হলে পঞ্চায়েতের কাজ বোঝার ক্ষেত্রে অসুবিধেয় পড়তে হবে। প্রত্যেক বাড়িতে শৌচাগার থাকাটা বাধ্যতামূলক করাও প্রয়োজন।”

এ দেশে সংসদ থেকে পঞ্চায়েত, কোনও স্তরেই ভোটে প্রার্থী হতে গেলে ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতার দরকার হয় না। এই প্রেক্ষাপটে সুপ্রিম কোর্টের গত কালের পর্যবেক্ষণ এক নতুন বিতর্ক উস্কে দিয়েছে। সে বিষয়ে ইন্ধন জুগিয়েছেন হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী মনোহরলাল খাট্টার স্বয়ং। পঞ্চায়েতের পর তিনি পুর-নির্বাচনের প্রার্থীদের ক্ষেত্রেও একই ধরনের অর্ডিন্যান্স আনতে চেয়েছেন। তাঁর প্রস্তাব, ‘‘সাংসদ-বিধায়কদের ক্ষেত্রেও ন্যূনতম যোগ্যতা বাধ্যতামূলক করা উচিত।’’ সে বিষয়টি অবশ্য কেন্দ্রের হাতে। সে ক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধিত্ব আইনে সংশোধনের সিদ্ধান্ত নিতে হবে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে।

আর সেখানেই আশঙ্কা। সংবিধান বিশেষজ্ঞ ইন্দিরা জয়সিংহ মনে করেন, এই রায় গণতন্ত্রের স্বাস্থ্যে প্রায় চূড়ান্ত আঘাত। এটা চলতে থাকলে ক্ষমতা ‘এলিট’ শ্রেণির হাতে চলে যাবে। তাঁর কথায়, এখানে স্কুলের শিক্ষাগত যোগ্যতার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এ দেশে অনেক শিক্ষিত রাজনীতিক আছেন, যাঁদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। তাই শুধু শিক্ষাগত যোগ্যতা কী করে মূল্যবোধের মাপকাঠি হতে পারে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন