Aravalli Hills Controversy

আরাবল্লী-সঙ্কটে গঙ্গা অববাহিকা নিয়ে শঙ্কা

অভিযোগ উঠছে, শিল্পপতিদের পকেট ভরাতে উত্তর-পশ্চিম ভারতের ‘ফুসফুস’ আরাবল্লীকে ধ্বংসের নকশা তৈরি করছে কেন্দ্র। আরাবল্লী থেকে নিকোবর দ্বীপ— সর্বত্রই উন্নয়নের নামে বুলডোজ়ার চালাচ্ছে মোদী সরকার।

স্বাতী মল্লিক

শেষ আপডেট: ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৯:৪৪
Share:

— ফাইল চিত্র।

‘‘রাজস্থানমে ডাকু হ্যায় ইয়া নেহি হ্যায়?’’

‘সোনার কেল্লা’ ছবিতে জটায়ু তথা লালমোহনবাবুকে দিয়ে প্রশ্নটা করিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। এত দিনে সেই ‘ডাকু’ গোটা উত্তর-পশ্চিম ভারতে ছড়িয়ে পড়ার উপক্রম। কারণ, খনি-ডাকাতের সৌজন্যে লুট হতে বসেছে আস্ত আরাবল্লী পাহাড়টাই!

অভিযোগ উঠছে, শিল্পপতিদের পকেট ভরাতে উত্তর-পশ্চিম ভারতের ‘ফুসফুস’ আরাবল্লীকে ধ্বংসের নকশা তৈরি করছে কেন্দ্র। আরাবল্লী থেকে নিকোবর দ্বীপ— সর্বত্রই উন্নয়নের নামে বুলডোজ়ার চালাচ্ছে মোদী সরকার। আরাবল্লী নিয়ে কেন্দ্রের প্রস্তাবিত সংজ্ঞায় সুপ্রিম কোর্টের অনুমোদন ‘মৃত্যুর পরোয়ানা’য় সই বলেও মন দেখছেন অনেকে। কারণ, এর ফলে গুজরাত-রাজস্থান-হরিয়ানা-দিল্লি পর্যন্ত বিস্তৃত, ৬৯০ কিলোমিটার দীর্ঘ আরাবল্লীর তলদেশে দেদার খনি, নির্মাণকাজ, সাফারি চালু হতে পারে। কেন্দ্রীয় পরিবেশমন্ত্রী ভূপেন্দ্র যাদবের আশ্বাসবাণীতেও ভুলছেন না পরিবেশকর্মীরা। বরং অনেকেরই আশঙ্কা, আরাবল্লী বিপন্ন হলে ছাড় পাবে না গঙ্গা অববাহিকাও। প্রাণিবিদ ও জলবিদেরা জানাচ্ছেন, আরাবল্লীর বুকে খনিকাজের ফলে মাটির স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়ে ভূপৃষ্ঠের বৃষ্টির জল শোষণের ক্ষমতা কমবে। ভূগর্ভস্থ জলস্তর কমলে বা দূষিত হলে জল সঙ্কটের সমস্যা গ্রাস করবে গোটা উত্তর-পশ্চিম ভারতকে। বাড়বে মরুকরণের আশঙ্কাও। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যার অধ্যাপক নারায়ণ ঘোড়াইয়ের মতে, ‘‘খনির খোঁড়াখুঁড়িতে স্থিতিশীল পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হবে। ছোট জলাশয় শুকিয়ে যাবে, জঙ্গল মরু এলাকায় পরিণত হবে। আরাবল্লীতেএমন হলে গঙ্গা অববাহিকার মতো দূরবর্তী অঞ্চলকেও অচিরে ফল ভুগতে হবে।’’

বীরভূমের বিস্তীর্ণ এলাকায় উন্মুক্ত খনির সমস্যা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করেছেন পরিবেশবিদ কুণাল দেব। তিনি বলছেন, ‘‘উন্মুক্ত খনির কাজ প্রথমে অল্প জায়গায় শুরু হলেও ক্রমশ তার ঋণাত্মক প্রভাব ছড়াতে থাকে। খনিজাত ধুলোর কারণে বায়ুদূষণ, জলদূষণ, স্বাস্থ্যের ক্ষয়ে আশপাশের গ্রাম, জমি ছেড়ে সরতে বাধ্য হন স্থানীয়েরা। ক্রমশ সেই এলাকা খনি-মালিকের দখলে যায়। আরাবল্লীতেও খনির প্রভাব এক সময়ে দিল্লির ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলবে, গিলে খাবে গুরুগ্রামকে। ক্রমশ ছড়াতে থাকবে এর ক্ষতিকারক প্রভাব। কারণ, সংরক্ষণ নয়, তখন মুনাফাই হবে লক্ষ্য।’’ ৩৬০ কোটি বছর আগে প্রাচীন পৃথিবীর শিলায় তৈরি আরাবল্লী আক্ষরিক অর্থেই ‘সোনার খনি’। বালিপাথর, চুনাপাথর, গ্র্যানাইট, মার্বেল এবং সোনা, তামা, দস্তা-সহ একাধিক খনিজে সমৃদ্ধ সে। থর মরুভূমির পূর্বমুখী অগ্রগতি রোধ করে দাঁড়িয়ে থাকা এই আরাবল্লীর নিচু অংশকে (আশপাশের এলাকা থেকে যে ভূখণ্ডের উচ্চতা ১০০ মিটারের কম) সরিয়ে ‘উন্নয়ন’-এর অর্থ যে বিপদকে ডেকে আনা, তা স্পষ্ট জানাচ্ছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সুশান্ত চৌধুরী। তাঁর মতে, আরাবল্লীর যে শিলাস্তর আগে অর্থনৈতিক ভাবে লাভযোগ্য ছিল না, তা এখন আধুনিকপ্রযুক্তির কল্যাণে অতি মূল্যবান। কিন্তু উন্মুক্ত খনিতে নিম্নমুখী খনন নির্দিষ্ট দূরত্বের পরে আর লাভজনক থাকে না। তখন তার পাশে সম্প্রসারণ অবশ্যম্ভাবী। নয়তো সেটিকে পরিত্যক্ত করতে হয়। সুশান্ত বলছেন, ‘‘আরাবল্লীর বুকে খননের ফলে মাটি-সহ বর্জ্য ক্রমশ জমা হতে থাকবে। সেখানে বৃষ্টির জল পড়লে সেই বর্জ্য থেকে ধাতব খনিজ চুঁইয়ে গিয়ে ভূগর্ভস্থ জলস্তরকে দূষিত করবে। সেই জল আশপাশে চাষের কাজে ব্যবহৃত হলে চাষের জমি ও ফসলেও দূষণ ছড়াবে। তাই একমাত্র আরাবল্লীর কোনও বন্ধ্যা জমিতে অল্প সময়ের জন্য খনির কাজ চালানোর কথা ভাবা যেতে পারে। না-হলে সমূহ বিপদ।’’

আরাবল্লী নিয়ে জনমত তৈরি ও আগামী প্রজন্মকে সচেতন করতে শীঘ্রই পড়ুয়াদের নিয়ে শোভাযাত্রার পরিকল্পনা করেছে কলকাতার খিদিরপুর কলেজ। ওই কলেজের ইকো ক্লাবের সদস্য এবং শিক্ষক তিস্তা দে ও সপ্তর্ষি চক্রবর্তী বলছেন, ‘‘বিপন্ন আরাবল্লীর জেরে ভূগর্ভস্থ জলস্তরের ক্ষতি হলে ছাড় পাবে না গঙ্গা অববাহিকাও। গঙ্গা ব-দ্বীপের বাস্তুতন্ত্র থেকে পরিবেশ, সবটাই আরাবল্লীর সঙ্গে পরোক্ষ ভাবে সম্পর্কযুক্ত। আজ আরাবল্লী বিপন্ন হলে কাল যে সুন্দরবনে হাত পড়বে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়? ’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন

এটি একটি প্রিমিয়াম খবর…

  • প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর

  • সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ

  • সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে

সাবস্ক্রাইব করুন