Atal Bihari Vajpayee

কলকাতার সেই দুই বাড়ি জুড়ে স্মৃতিমেদুর গন্ধ

কমলের স্মৃতি এখনও অটুট, “আমাদের ভাইবোনদের সঙ্গে খেলতেন। আমরা হয়তো বাড়িতে নেই। বাড়ির মেয়েদের নিয়ে দুপুরে জমাটি আড্ডা চলত।”

Advertisement

সিজার মণ্ডল

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ অগস্ট ২০১৮ ১৮:১৬
Share:

বেরিওয়াল পরিবারের সঙ্গে অন্তরঙ্গ মুহূর্তে অটলবিহারী বাজপেয়ী। ছবি: পারিবারিক অ্যালবাম থেকে সংগৃহীত।

মাছ খাওয়া আর সিনেমা দেখার হুজুগ উঠলে অটলজিকে রোখা যেত না। দিল্লির এইমস থেকে কলকাতার চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের বেরিওয়াল হাউজের দূরত্বটা কয়েক হাজার কিলোমিটার। কিন্তু গোটা বাড়ি জুড়ে ছড়িয়ে আছে নিকটাত্মীয়কে চিরকালের মতো হারানোর বেদনা।

Advertisement

মহাজাতি সদনের উল্টো দিকের এই পাঁচ তলা বাড়ির গোটা চার তলা জুড়ে ছড়িয়ে আছে অটলবিহারী বাজপেয়ীর অসংখ্য স্মৃতি।

কমল বেরিওয়ালের স্মৃতি এখনও খুব স্পষ্ট। আশির দশকের মাঝামাঝি বাজারে ভিসিপি এল। কমলের মনে আছে, “সারা দুপুর সে দিন হিন্দি সিনেমা দেখে কাটালেন অটলজি। একা নয়। বাড়ির মেয়ে-বাচ্চা সবার সঙ্গে।” পুরনো হিন্দি ছবি দেখতে এতটাই ভালবাসতেন ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী।

Advertisement

দেখুন ভিডিয়ো

বেরিওয়ালদের পারিবারিক ব্যবসা স্টিলের। স্বাধীনতার কিছু দিন পরেই দিল্লিতে যুবক স্বয়ংসেবক অটলবিহারী বাজপেয়ীর সঙ্গে আলাপ তরুণ ঘনশ্যাম বেরিওয়ালের। সেই আলাপ থেকে বন্ধুত্ব। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই বন্ধুত্ব আরও দৃঢ় হয়। তারপর সেই বন্ধুত্বের সূত্র ধরেই ১৯৫৬ সালের এক শীতের সকালে ঘনশ্যামের বাড়িতে হাজির যুবা সংগঠক অটলবিহারী বাজপেয়ী। তার পর থেকে কলকাতায় এলেই বেশির ভাগ সময় এই বেরিওয়াল হাউসই ঠিকানা হত তাঁর। সেই ধারা অব্যাহত ছিল ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরেও। কিন্তু তারপর নিরাপত্তা এবং প্রোটোকলের জালে বন্ধুর বাড়ি আর আসা হয়নি তাঁর। তবে বন্ধু ঘনশ্যাম এবং তাঁর পরিবারের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ থেকে গিয়েছিল।

বেরিয়াল পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে অটল বিহারী বাজপেয়ী। ছবি: পারিবারিক অ্যালবাম থেকে সংগৃহীত।

ঘনশ্যামের পাঁচ ছেলেমেয়ের মধ্যে এক জন কমল। তিনি বললেন, “অসাধারণ মজার মানুষ ছিলেন তিনি। বাড়িতেই একটা ঘর ছিল বৈঠকের। খুব সকালে উঠতেন। সকাল থেকে একের পর এক বৈঠক। তখন স্নান-খাওয়া ভুলে যেতেন। কিন্তু একটা নিয়মে নড়চড় হত না। রাত ন’টার মধ্যে শুয়ে পড়তেন।”

বেরিওয়াল হাউসে এখনও একটা ঘর তালা বন্ধ থাকে। ছিমছাম দক্ষিণ খোলা একটা ঘর। কলকাতায় এলে সেই ঘরেই শুতেন তিনি। বৃহস্পতিবার দুপুরে সেই ঘরে বসেই কথা বলছিলেন কমল। বিছানার পাশে ছোট্ট টেবিলে অটলবিহারীর একটি ছবি। মার্বেল করা মেঝে ঝকঝক করছে। বোঝা যায়, অটলবিহারী না থাকলেও রোজ নিয়ম করে সাফসুতরো করা হয় এই ঘর।

কলকাতায় এলে বেরিওয়াল হাউসের এই ঘরেই থাকতেন অটলবিহারী বাজপেয়ী। নিজস্ব চিত্র।

কাজ শেষ হলেই সেই বিশাল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বই পুরো ছেলেমানুষ হয়ে যেতেন। কমলের স্মৃতি এখনও অটুট, “আমাদের ভাইবোনদের সঙ্গে খেলতেন। আমরা হয়তো বাড়িতে নেই। বাড়ির মেয়েদের নিয়ে দুপুরে জমাটি আড্ডা চলত।”

আর খাওয়াদাওয়া? কমলের কথায়, ‘‘এমনিতে খুব হালকা, কম তেলমশলার খাবার খেতেন। কিন্তু রসগোল্লা আর কলকাতার মিষ্টি দইয়ের প্রতি তাঁর ছিল মারাত্মক ভালবাসা। তিনি বলেন, “তখন অটলজির সুগার বেশ হাই। মিষ্টি খাওয়া একদম বারণ। কিন্তু কলকাতায় এলে রসগোল্লা ছিল মাস্ট। বার বার না করলেও শুনতেন না।”

আর একই রকম পাগলামি ছিল মাছ খাওয়া নিয়ে। কমল বলেন, “আমরা নিরামিশাষী। তাই মাঝেমধ্যেই সুকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, ডাঃ সুজিত কুমার ধরের মতো পুরনো বন্ধুদের ফোন করে, সবাই মিলে খেতে বেরিয়ে পরতেন। একদম বাংলা খানা। হয় এঁদের কারও বাড়িতে, নয়তো রেস্তঁরাতে। খেতে খুব ভালবাসতেন অটলজি।”

সেই পুরনো বন্ধুদের কেউই প্রায় বেঁচে নেই। কিন্তু স্মৃতি রয়ে গিয়েছে সেই পরিবারগুলিতে। ডাঃ ধরের স্ত্রী মহুয়া ধর। অটলজির কথা বললেই তাঁর মনে পড়ে সেই দিলখোলা মানুষটাকে। মহুয়া বলেন, “সময়টা সাতের দশক। বিজেপি ছিল না তখন। জনসঙ্ঘ ছিল। এয়ারপোর্টে নেমেই বাড়িতে ফোন করতেন। কখনও এয়ারপোর্টে ডেকে নিতেন আমার স্বামীকে। আবার কখনও সটান চলে আসতেন আমাদের চক্রবেড়িয়া রোডের বাড়ি।”

স্বামী সুজিত কুমার ধর আরএসএসের একসময়ের হোলটাইমার ছিলেন। তার পরে সংগঠনের নির্দেশেই ডাক্তারিতে ফিরে আসেন। মহুয়া চক্রবেড়িয়া রোডের বাড়িতে অশোক সিঙ্ঘল থেকে শুরু করে মুরলীমনোহর যোশী বা অটলবিহারী বাজপেয়ী, সবাইকেই দেখেছেন। তিনি বলেন, “আমি তো সংসার নিয়ে থাকতাম। রাজনীতির ধারেকাছে থাকতাম না। কিন্তু ওনার মতো শান্ত সৌম্য মানুষ আমি খুব কম দেখেছি।”

আরও পড়ুন: শ্রীঅটলবিহারী বাজপেয়ী (১৯২৪-২০১৮)

গৃহিণী হিসেবে অতিথির দেখভাল করা ছিল তাঁর প্রধান দায়িত্ব। তাঁর এখনও মনে আছে, “এমনিতে সব সময় বলতেন, কম তেলমশলা দিয়ে রান্না করতে। কিন্তু বাড়ি এলেই একটা আবদার থাকত। আমাকে বলতেন শুক্তো করতে। শুক্তো খেতে খুব ভালবাসতেন। আর শেষ পাতে ভবানীপুরের দোকানের মিষ্টি দই।” তাঁর আরও মনে আছে, ‘‘অটলজি আমাদের সঙ্গে কথা বলার সময় বাংলা বলার চেষ্টা করতেন। ঠিক বলতে পারলেই মুখে একটা তৃপ্তি ফুটে উঠতো।’’

আরও পড়ুন: ‘গীত নয়া গাতা হুঁ’ শুনুন বাজপেয়ীর সেই কণ্ঠস্বর

এই ছোট ছোট স্মৃতি সঙ্গে নিয়েই মহুয়া ধর, বেরিওয়াল পরিবারের একটাই দুঃখ— এক দিন না এক দিন তো সবাই মারা যাবেন। কিন্তু অটলজির চলে যাওয়া মানে রাজনীতি থেকে এক জন ভাল মানুষ কমে যাওয়া।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন