সার্জিক্যাল স্ট্রাইক-ই কি সব অসুখ সারানোর জাদুবড়ি?

ভোটের ডাকে তৃণমূল সাংসদ পরাস্ত করলেন যোগগুরু বাবা রামদেবকে!শনিবার সন্ধ্যায় ক্যালকাটা ক্লাব-দ্য টেলিগ্রাফ বিতর্কে বাবা রামদেব বলছিলেন, ‘‘আমি তো বহুজাতিক বিদেশি কোম্পানিগুলির বিরুদ্ধে রোজই সার্জিক্যাল স্ট্রাইক চালাই।

Advertisement

গৌতম চক্রবর্তী

কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ জানুয়ারি ২০১৭ ০৩:১৫
Share:

তর্ক শেষে। ‘দ্য টেলিগ্রাফ ন্যাশনাল ডিবেট’-এর মঞ্চে (বাঁ দিক থেকে) শাইনা এনসি, সম্বিত পাত্র, জহর সরকার, বাবা রামদেব, কানহাইয়া কুমার ও সুগত বসু। শনিবার ক্যালকাটা ক্লাবে। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য।

ভোটের ডাকে তৃণমূল সাংসদ পরাস্ত করলেন যোগগুরু বাবা রামদেবকে!

Advertisement

শনিবার সন্ধ্যায় ক্যালকাটা ক্লাব-দ্য টেলিগ্রাফ বিতর্কে বাবা রামদেব বলছিলেন, ‘‘আমি তো বহুজাতিক বিদেশি কোম্পানিগুলির বিরুদ্ধে রোজই সার্জিক্যাল স্ট্রাইক চালাই। বৈজ্ঞানিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও সমগ্র দৃষ্টিভঙ্গিতে গোটা বিষয়টা বুঝতে হবে। প্রধানমন্ত্রী কেন দেশের সুরক্ষা, কালো টাকা উদ্ধার নিয়ে অযথা মিথ্যা কথা বলতে যাবেন?’’

বিতর্কে বিপক্ষেও বাবার ভক্তরা আছেন। জহর সরকার বলছিলেন, পতঞ্জলির ওষুধে তিনি সুফল পেয়েছেন। কিন্তু প্রায় উইকিপিডিয়ার ধাঁচে তিনি জানালেন, ‘‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক বেশির ভাগ জায়গায় ব্যর্থ হয়। কিউবার বিরুদ্ধে আমেরিকাকেও মুখ পুড়িয়ে ফিরে আসতে হয়েছিল।’’ আর সাংসদ সুগত বসু বিতর্কের ভোটাভুটিকে নিয়ে গেলেন অন্য মাত্রায়— ‘‘আসুন, ২০১৯ সালে লোকসভা ভোটের ফল যা হবে, তা এই লনেই আপনারা দেখিয়ে দিন।’’ তার পরই ‘সভার মতে, সার্জিক্যাল স্ট্রাইক সব রোগের ওষুধ’ প্রস্তাব পরাস্ত।

Advertisement

সুগতবাবুর পাশাপাশি প্রস্তাবের বিপক্ষে বলছিলেন জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের বামপন্থী ছাত্রনেতা কানহাইয়া কুমারও, ‘‘আমরা তো কাজ করি না, রোজ নতুন ব্র্যান্ডিং করি।’’ চরকা-কাটা নরেন্দ্র মোদীর খাদি বিজ্ঞাপনের পর যুক্তি আর বাড়ানোর দরকার ছিল না। শীত-সন্ধ্যায় শাল, সোয়েটার, ফিরান পরিহিতা সুবেশা, সুগন্ধি-ছড়ানো মহিলাদের করতালিতে ভরে গেল অভিজাত ক্লাবের লন।

মহিলাদের নিরিখে এই শহরের পুরুষেরা কি একটু বেশি জাতীয়তাবাদী? বিজেপির মুখপাত্র সম্বিত পাত্রের চমৎকার বাগ্মিতায় তাঁরা প্রায় ভেসেই গিয়েছিলেন। ‘‘সবাই বলছেন, মনমোহন দয়া দেখিয়েছেন, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর উর্জিত পটেলকে সংসদীয় কমিটির জেরার হাত থেকে বাঁচিয়েছেন।’’ অতঃপর তুখড় অঙ্গভঙ্গিতে: ‘‘আরে বাবা, মনমোহন তো দয়ালু। টুজি স্ক্যাম, কয়লা স্ক্যাম সর্বত্র দয়া দেখিয়েছেন।’’ লন ভেসে গেল হাততালিতে। সেই করতালির বহর অস্বীকার করতে পারলেন না সুগতবাবুও: ‘‘ভেবেছিলাম, রামদেবের শীর্ষাসন দেখব। তার বদলে সম্বিত যে বিতর্ক থেকে বেরিয়ে কী ভাবে কিছু মিথ্যার ওপর সন্ধ্যাটাকে দাঁড় করালেন, সেটাই দেখলাম।’’ তাঁর এই বক্তব্যের পরেই সঞ্চালক সঙ্কর্ষণ ঠাকুর দর্শকদের ভোট গোনার রায় দিলেন। সার্জিক্যাল স্ট্রাইক-ই কি সব অসুখ সারানোর জাদুবড়ি? লনে হাত উঠল, উপরন্তু ক্লাবের বারান্দায় বসে কেতাদুরস্ত জনা কয়েক মাঝবয়সি পুরুষ হুঙ্কার দিলেন, ‘ইয়েস!’ কিন্তু হাতগণনায় সেই পুরুষালি হুঙ্কার পরাস্ত। সম্বিত অবশ্য সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের সমর্থনে এক নারীকে নিয়ে এসেছিলেন। তিনি মা দুর্গা। ‘‘মা দুর্গা সাহস দেখিয়েছিলেন, ভ্রষ্টাচারী মহিষাসুরকে নিকেশ করেছিলেন। মহিষাসুরের পর শুম্ভ-নিশুম্ভ আসবে, রক্তবীজ আসবে, আমি কী করব ভেবে সনিয়া-রাহুলদের মতো হাত গুটিয়ে বসে থাকেননি। কর্ম করতে হয়,’’ জ্বালাময়ী এই কর্মযোগের কথার সঙ্গে সঙ্গে হাততালি।

সম্বিতের কর্মযোগ এ দিন সর্বব্যাপী, ‘‘এই শহর রামমোহনের। লোকের কথা না শুনে তিনি সতীদাহ বন্ধ করেছিলেন, সেটি সার্জিক্যাল স্ট্রাইক। বিবেকানন্দ নতুন চিন্তার সন্ধান দিয়েছিলেন, লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলম্যান না বলে আমেরিকাবাসী ভাইবোন বলেছিলেন, ওটাই সার্জিক্যাল স্ট্রাইক।’’ উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়লেন সকলে।

কিন্তু সুগত? ইতিহাসবিদের মতোই তিনি বুঝিয়ে দিলেন, সম্বিতের ধারালো কথায় চমক আছে, যুক্তি নেই। ‘‘রামমোহন যুক্তির কথা বলতেন, হিন্দু ধর্মের অনাচার দেখে ব্রাহ্মধর্ম তৈরি করেছিলেন। বিজেপি পারবে? বিবেকানন্দ সর্বধর্মসমন্বয়ের কথা বলেছিলেন। বিজেপি করবে?’’

সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের সমর্থনে বিতর্ক শুরু করেছিলেন মহারাষ্ট্রের শাইনা এনসি। আপ থেকে বিজেপিতে আসা ফ্যাশন ডিজাইনার নেত্রী জানালেন, দেশ এই প্রথম এক জন সৎ নেতা পেয়েছে, যিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করেন।

শাইনার পক্ষ নিয়ে ডাক্তারি পাশ-করা সম্বিত প্রথমেই বললেন, সার্জিক্যাল স্ট্রাইক কাকে বলে! যেমন টিউমার অপারেশন। সার্জনের ছুরি টিউমার কেটে বের করে আনবে, কিন্তু অন্যত্র রক্তপাত হবে না। এখানেই ছিল ‘অ্যাকিলিসের গোড়ালি।’ বিপক্ষ বারংবার বলল, নিয়ন্ত্রণরেখায় সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করে কাশ্মীর সমস্যার সমাধান হল না, কালো টাকায় অপারেশন চালিয়েও লাভ হল না। নিজেদের টিমকে জেতাতে রামদেব, সম্বিতরা তাঁদের কাজ আপ্রাণ করে গিয়েছেন। কিন্তু শেষ অবধি ওই যে গীতার কথা! কর্মে তোমার অধিকার, ফলেতে নয়।

শাইনা-সম্বিত-রামদেবরা এ দিন পরাস্ত! ভোট গণনার ফলে তাঁদের হাত ছিল না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন