ওরা ১৫ মিনিট সময় দিয়েছিল ব্যাগ গোছাতে

মুক্তির স্বাদ মিলেছিল গত কালই। তবু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটা ছেড়ে কখন ঘরে ফিরবেন, কখন দেখা মিলবে প্রিয়জনের, চরমে পৌঁছেছিল সে উৎকণ্ঠা। দুপুর বারোটা নাগাদ কোচি বিমানবন্দরে পা ফেলতেই চকচক করে উঠল স্যান্ড্রা সেবাস্তিয়ানের মুখ। অল্পবয়সি নার্সটি বলে উঠলেন, “আর ইরাকে ফিরছি না। কোনও প্রশ্নই নেই!”

Advertisement

সংবাদ সংস্থা

কোচি শেষ আপডেট: ০৬ জুলাই ২০১৪ ০২:৩১
Share:

ঘরে ফেরা। ইরাক থেকে দেশে ফিরে ভাইপোকে আদর এক ভারতীয় নার্সের। শনিবার কোচি বিমানবন্দরে। ছবি: এ পি

মুক্তির স্বাদ মিলেছিল গত কালই। তবু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটা ছেড়ে কখন ঘরে ফিরবেন, কখন দেখা মিলবে প্রিয়জনের, চরমে পৌঁছেছিল সে উৎকণ্ঠা। দুপুর বারোটা নাগাদ কোচি বিমানবন্দরে পা ফেলতেই চকচক করে উঠল স্যান্ড্রা সেবাস্তিয়ানের মুখ। অল্পবয়সি নার্সটি বলে উঠলেন, “আর ইরাকে ফিরছি না। কোনও প্রশ্নই নেই!”

Advertisement

বাকি ৪৫ জন নার্সের সঙ্গে স্যান্ড্রাও আজ দেশে ফিরেছেন। গত বছর অগস্ট মাসে চাকরিসূত্রে ইরাকে গিয়েছিলেন তিনি। তখন পরিস্থিতি এক প্রকার ঠিকঠাকই ছিল। কিন্তু গত চার মাসের অভিজ্ঞতা দুঃস্বপ্নের মতো। তিকরিত ট্রেনিং হাসপাতালে উপচে পড়েছে রোগী। অধিকাংশই গুলি-বোমায় জখম। স্যান্ড্রাদের হাসপাতাল চত্বরেও বেশ কয়েক বার বোমা পড়েছিল। গুলিগোলার আওয়াজে বহু রাতেই দু’চোখের পাতা এক করতে পারেননি তাঁরা। জানালেন, প্রতিদিনই মনে হতো, আর বুঝি রক্ষে নেই। সোনা নামের আর এক নার্স বললেন, “রাতে মাঝেমধ্যেই বোমা পড়ার শব্দে ঘুম ভেঙে যেত। শোয়া থেকে উঠে বসে থাকতাম। ও ভাবেই কেটে যেত রাত।” এর পরও হাসপাতালে থেকেই রোগীর সেবা করে গিয়েছেন তাঁরা। বদলে জোটেনি বেতনটুকুও।

“আগে আমরা ২৩ জন নার্স একসঙ্গে ছিলাম। গত ফেব্রুয়ারিতে আরও ১৫ জন যোগ দেন”, বললেন স্যান্ড্রা। সে কথা প্রসঙ্গে আর এক নার্স নীনু জোস জানালেন, অনেক আগে থেকেই তাঁদের সকলকে অন্যত্র সরে যাওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছিল জঙ্গিরা। তিকরিত শহরটা যে বহু দিন হল জঙ্গি-দখলে। কিন্তু ভারতীয় দূতাবাস থেকে বারবার সতর্ক করে দেওয়ায়, জঙ্গিদের দাবি কানে তোলেননি তাঁরা।

Advertisement

যদিও সে জোরজার আর ধোপে টেকেনি ৩ জুলাই। মালপত্র গোছানোর জন্য মাত্র ১৫ মিনিট সময় দেওয়া হয় নীনুদের। আর তার পরই তিকরিত থেকে ৪৬ জন ভারতীয় নার্সকে সরিয়ে নিয়ে যায় জঙ্গিরা। স্যান্ড্রা বললেন, “ওরা এসে বলে, তোমরা আমাদের বোনের মতো। কোনও ক্ষতি করব না। কিন্তু তাতে কী আর ভয় যায়...। কেউ তখন বিশ্বাসই করিনি ওদের কথা। চারটে বাসে তুলে দেওয়া হয় আমাদের। দুপুর বারোটা নাগাদ রওনা হই অজানা গন্তব্যে। সাত ঘণ্টার যাত্রাপথ। সে পথও সহজ ছিল না।”

সোনা জানালেন, যত বারই জানতে চাওয়া হচ্ছিল কোথায় যাচ্ছি, আলাদা আলাদা জায়গার নাম করছিল জঙ্গিরা। তাতে মানসিক চাপটা আরও বাড়ে। “ওদের সঙ্গে বন্দুক-বোমা, সবই ছিল। সন্দেহের অবকাশ তাই থেকেই যাচ্ছিল”, বললেন তিনি।

মসুলে পৌঁছে খানিক স্বস্তি মেলে। নীনুর কথায়, “জঙ্গিরা থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। কোনও ক্ষতি করেনি।” সে প্রসঙ্গে কান্নুরের বাসিন্দা সুনি মোল চোকোর দাবি, “ওদের জঙ্গি বলা ঠিক নয়। স্থানীয় প্রশাসনেরই একটা অংশ ওরা।”

মেয়েদের ফিরে পেয়ে

বিহ্বল পরিজনেরাও। কোচি বিমানবন্দরে অনেককেই দেখা গেল চোখের জল ফেলতে। এক নার্সকে দেখা গেল বৃদ্ধ দাদু-দিদাকে জড়িতে ধরে কাঁদতে। কেউ বা কোলে তুলে নিলেন ছেলেকে। মায়ের গলা দু’হাতে জড়িয়ে খুদের আহ্লাদ তখন দেখে কে!

কোট্টায়ামের মারিনা যেমন কাঁদতে কাঁদতে জড়িয়ে ধরলেন দু’বছরের মেয়ে রেয়া আর ছেলে মেরিনকে। ১১ মাস পরে দেখা। তা-ও আইএসআইএস-এর হাত থেকে বেঁচে ফিরবেন, ভাবতে পারেননি।

এ দিকে, মেয়েকে ফিরে পেয়েও দুশ্চিন্তা কাটছে না এর্নাকুলামের বাসিন্দা এলানজি বালকৃষ্ণনের। বললেন, “দু’লাখ টাকা ধার নিয়ে গত বছর মেয়ে রেণুকে ইরাকে পাঠিয়েছিলাম। পরিবর্তে বন্দক রাখি জমিজমা-বাড়িঘর। মেয়ে তো গত তিন মাস মাইনেই পায়নি।

এ বার কী হবে?” প্রায় একই কথা শোনা গেল কেরলের শান্তাম্মার মুখেও। পাঁচ মাস আগেই তিনি মেয়েকে ইরাকে পাঠিয়েছিলেন। সে জন্য ধার করেছিলেন ৫ লক্ষ টাকা। শোধ করবেন কী ভাবে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন