অসমে জাতীয় নাগরিক পঞ্জি নবীকরণ নিয়ে বাংলাভাষীদের মধ্যে আশঙ্কা ক্রমাগত বাড়ছে। নিজেদের নিরাপত্তায় আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বিভিন্ন সংগঠন। শিলচরে নাগরিক সভা হয়েছে। বঙ্গভবনে সাধারণ মানুষের মতামত জানতে চেয়েছে অখিল ভারত অধিবক্তা পরিষদ। গুরুচরণ কলেজের অধ্যক্ষ তাপসশঙ্কর দত্ত, করিমগঞ্জ কলেজের অধ্যক্ষ কামালউদ্দিন আহমেদ, ১৯৬১ সালের ভাষা আন্দোলনের প্রধান পরিতোষ পালচৌধুরীরাও আন্দোলনের পথে এগোতে প্রস্তুত হচ্ছেন। এসইউসি নেতা অরুণাংশু ভট্টাচার্য বলেন, “এক জনও প্রকৃত ভারতীয় নাগরিক যেন বিদেশি হিসেবে বিতাড়িত না-হন, সে দিকে নজর রাখতে হবে।”
সারা ভারত কৃষক ও খেতমজুর সংগঠনের রাজ্য সম্পাদক সুরতজামান মণ্ডল বলেন, “অসমের বাংলাভাষীদের উপর যা চলছে, তা আইনবিরুদ্ধে। দেশের জনপ্রতিনিধিত্ব আইনে বলা হয়েছে, আদালতে দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত অভিযুক্তরাও ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন। কিন্তু এখানে পুলিশের সন্দেহ হলেই কোনও বঙ্গভাষীর নামের পাশে ‘ডি ভোটার’ লিখে দেওয়া হয়। বাতিল হয় তাঁর ভোটাধিকার!” তিনি জানান, ফের ওই অধিকার ফিরে পেতে ট্রাইব্যুনালের রায়ের অপেক্ষা করতে হয়। সেখানে অনেককে ভারতীয় বলে মানা হলেও, ওই ব্যক্তি ভোটাধিকার ফিরে পাচ্ছেন না। বিশ্বজুড়ে জন্মসূত্রেই নাগরিকত্ব মেলে। অসমে তা প্রযোজ্য নয়। পূর্বপুরুষদের নাগরিকত্বের প্রমাণই এক মাত্র বিচার্য। মহিলাদের বৈবাহিক সূত্রও এ ক্ষেত্রে কার্যকর নয়। বিবাহিত মহিলাদের পূর্বপুরুষদের পরিচয় সংক্রান্ত কাগজ দেখাতে হয়। তৃতীয়ত, এখানে সন্দেহভাজন কোনও ব্যক্তিকেই নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার কথা বলা হয়েছে। তা প্রমাণ করতে না-পারলে তাঁকে দোষী বলে চিহ্নিত করা হবে। কামালউদ্দিনের বক্তব্য, “আইন, চুক্তি কিছুই মানা হচ্ছে না। ও পারে নির্যাতনের শিকার হয়ে এ পারে আশ্রয় নিলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নাগরিকত্ব প্রদানের চুক্তি হয়েছিল ভারত ও পাক রাষ্ট্রনেতাদের মধ্যে। গুজরাত, রাজস্থানে তা মানল এখানে কেন আপত্তি?” হাইলাকান্দির প্রবীণ লেখক মানসকান্তি দাসের মন্তব্য, “আইন শাস্ত্রে প্রত্যক্ষদর্শীর প্রমাণের কথা বলা হয়েছে। নাগরিকত্ব প্রমাণেও তাতে গুরুত্ব দেওয়া হোক। যাঁদের নথি নেই, পড়শিদের সাক্ষ্যই যেন গুরুত্ব পাক।”
এমন পরিস্থিতিতে বরাকে নাগরিকত্ব সুরক্ষা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়েছে। সেটির আহ্বায়ক হলেন শশাঙ্কশেখর পাল, প্রদীপ দেব, অরুণাংশু ভট্টাচার্য, রঞ্জিত ঘোষ ও প্রভাসচন্দ্র সরকার। কমিটির সদস্যরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে নাগরিক পঞ্জির বিষয়ে প্রচার চালাবেন। সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচিও ঠিক করা হয়েছে। লিফলেট বিলি করা হবে। জেলাশাসকের মাধ্যমে চিঠি পাঠানো হবে প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রীকে। অধিবক্তা পরিষদও একই কারণে সভা করেছে। সভাপতি অনিলচন্দ্র দে জানান, কয়েকটি সংগঠন তাঁদের সঙ্গে জোট বেঁধেছে। কয়েক দিনের মধ্যেই একটি প্রতিনিধি দল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দেখা করবে। প্রতিটি বিধানসভা কেন্দ্রে ‘এনআরসি’-র মতো কেন্দ্র গঠন করা হবে। সে জন্য বরাক উপত্যকা কমিটি গঠনেরও সিদ্ধান্ত হয়। কমিটি হবে বিধানসভা কেন্দ্র ভিত্তিক।
নাগরিক পঞ্জি রূপায়ণ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত স্বরাষ্ট্র কমিশনার প্রতীক হাজেলা জানান, মার্চে ফর্ম বিলি শুরু হওয়ার কথা থাকলেও দেরি হচ্ছে। এপ্রিল থেকে এনআরসি-র ফর্ম দেওয়া শুরু হবে। নাগরিক পঞ্জিতে নাম তোলার জন্য ভিত্তিবর্ষ ও তারিখ ১ জানুয়ারি ১৯৬৬। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, ১৯৬৬ থেকে ১৯৭৫ সালের ২৪ মার্চ মধ্যরাত্রি পর্যন্ত যাঁরা অসমে এসেছেন, তাঁদের কিছু শর্তসাপেক্ষে বিতাড়ন করা হবে না। ১৯৬৬ সালের আগে থেকে যাঁরা অসমে রয়েছেন তাঁদের জন্য নাগরিক পঞ্জিতে নাম তোলা সহজ হবে। তা ছাড়া ১৯৫১ সালের এনআরসি বা ১৯৬৭ সালের ভোটার তালিকায় নাম থাকলেও সুবিধা মিলবে।
হাজেলার হিসেবে, ১৯৬৬ থেকে ১৯৭৫-এর মধ্যে বাইরে থেকে অসমে আসা মানুষের সংখ্যা ৩৩ হাজার। তাঁদের মধ্যে ১৩ হাজার মানুষ ইতিমধ্যেই নাম নথিভুক্ত করিয়েছেন। এই কাজে রাজ্যে আড়াই হাজার এনআরসি সেবা কেন্দ্র তৈরি করা হয়েছে। সেখান থেকে ১৯৫১ সালের এনআরসি ও ১৯৭১ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত ভোটার তালিকা মিলবে।
(শেষ)