নিত্যনতুন প্রযুক্তি। নিত্যনতুন মোবাইল সেটের বাহার। কোনটা ছেড়ে কোনটা কিনি!
কিন্তু সেট যতই বাহারি বা দামি হোক, কল করতে গিয়ে পদে পদে হোঁচট! কথাবার্তার মাঝপথে লাইন উধাও হওয়া যেন নিয়মে দাঁড়িয়েছে। উপরন্তু অনেক ক্ষেত্রে ‘কাটা’ কলের মাসুলও গ্রাহককে গুনতে হচ্ছে। ফোন কল একমুখী হয়ে থাকার ঘটনাও আকছার।
পরিস্থিতি এমনই যে, নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হয়েছে টেলিকম মন্ত্রক। তাদের সিদ্ধান্ত, মোবাইলে নিরবিচ্ছিন্ন পরিষেবা সুনিশ্চিত করতে দু’মাস অন্তর সর্বত্র ‘মোবাইল ড্রাইভ টেস্ট’ হবে। সেটা কী?
মানে, গাড়িতে ল্যাপটপ নিয়ে বসে থাকবেন ইঞ্জিনিয়ারেরা। ল্যাপটপে লাগানো থাকবে বিভিন্ন নেটওয়ার্কের মোবাইল ফোন। টাওয়ারের কাছে পৌঁছে তাঁরা সংশ্লিষ্ট নেটওয়ার্কের ফোন চালু করে কথা বলবেন। কল করা মাত্র ল্যাপটপের এক বিশেষ সফ্টওয়্যার মারফত রের্কড হয়ে যাবে ওই কল সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য— কল কতটা নিরবিচ্ছিন্ন, শব্দ কতটা পরিষ্কার, কল করার কতক্ষণ বাদে তা নির্দিষ্ট নম্বরের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে, ইত্যাদি।
এবং ইঞ্জিনিয়ারদের দাবি, ওই পরীক্ষাতেই মালুম হয়ে যাবে, কোন নেটওয়ার্ক পরিষেবা সংস্থা কতটা ঠিকঠাক পরিষেবা দিচ্ছে। কারও পরিষেবা-মান সন্তোষজনক না-হলে তার কাছে ব্যাখ্যা তলব হবে। জানতে চাওয়া হবে, তারা পরিষেবার উন্নতি ঘটাতে কী ব্যবস্থা নিচ্ছে।
সূচনা হিসেবে আজ সোমবার কলকাতার আনাচে-কানাচে শুরু হচ্ছে টেলিকম রেগুলেটরি অথরিটি (ট্রাই)-এর এই অভিযান। চলবে টানা ছ’দিন। ‘‘বস্তুত মোবাইলে কথোপকথনকালে আচমকা লাইন কেটে যাওয়া, অর্থাৎ কল ড্রপ-এর সমস্যাটি এতই গুরুতর চেহারা নিয়েছে যে, এ ধরনের পদক্ষেপ ছাড়া গতি নেই।’’— বলছেন এক টেলিকম-কর্তা। কল ড্রপ হচ্ছে কেন?
টেলিকম-ইঞ্জিনিয়ারদের ব্যাখ্যা: ধরা যাক, রাম তাঁর মোবাইল থেকে শ্যামকে কল করলেন। যে মহূর্তে কথা শুরু হল, সঙ্গে সঙ্গে রামের মোবাইল সংশ্লিষ্ট নেটওয়ার্কের নিকটবর্তী টাওয়ারকে রেডিও ফ্রিকোয়েন্সির মাধ্যমে কলটি সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্যও পাঠাতে থাকল। শব্দ কতটা পরিষ্কার, অন্য কোনও রেডিও ফ্রিকোয়েন্সির সঙ্গে শব্দের সঙ্গে জট পাকাচ্ছে কি না, ইত্যাদি ইত্যাদি। তথ্যগুলোর ঠিকঠাক বিশ্লেষণ না-হলে কলটি টাওয়ার থেকেই আপনা-আপনি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
অর্থাৎ, কল ড্রপ। যার পিছনে মূলত পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থার প্রযুক্তিগত বিভ্রাটের ভূমিকা দেখছেন টেলিকম-কর্তারা। দায় ঝাড়তে সংস্থাগুলি ‘অন্য রাস্তা’ নিচ্ছে কিনা, তা-ও ওঁরা যাচাই করতে চাইছেন। কী রকম?
টেলিকম-সূত্রের খবর: একটা মোবাইল টাওয়ার কখন কল বিচ্ছিন্ন করবে, তার নির্দিষ্ট একটা পরিমাপ রয়েছে। পরিভাষায়, ‘রেডিও লিঙ্ক টাইম আউট।’ সংক্ষেপে আরএলটি। এখন আরএলটি মোটামুটি ২৪-৩২। কিন্তু কোনও সংস্থা আরএলটি-র পরিমাপ (ভ্যালু) আরও বাড়িয়ে দিলে ব্যাপারটা অন্য দিকে গড়াবে। তখন রাম তাঁর ফোনে কিছু শুনতে না-পেলেও কল আপনা-আপনি কাটবে না। শেষমেশ তিনি বিরক্ত হয়ে নিজেই কলটি কেটে দেবেন। ‘‘তখন কিন্তু বলা যাবে না যে, কল ড্রপ হয়েছে।’’— মন্তব্য এক টেলিকম-আধিকারিকের।
ফলে পরিষেবায় ঘাটতি সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট সংস্থার ঘাড়ে সরকারি ভাবে দায় চাপানো যাবে না। এই লুকোচুরির পথটাও বন্ধ করার চেষ্টা হচ্ছে। টেলিকম-কর্তারা জানাচ্ছেন, প্রতিটি কল ড্রপ আলাদা ভাবে চিহ্নিত না-হলে বোঝা যাবে না, সংস্থাগুলি ঠিকঠাক পরিষেবা দিচ্ছে কি না। কলকাতার টেলিকম এনফোর্সমেন্ট অ্যান্ড রিসোর্স মনিটরিং সেলের ডিরেক্টর মণীশ দাস রবিবার বলেন, ‘‘ড্রাইভ টেস্টের পাশাপাশি পরিষেবা সংস্থার কাছ থেকে গ্রাহকের কল ডিটেলস রেকর্ড (সিডিআর) চাওয়া হচ্ছে। সেগুলো দেখেও জানা যাবে, কল ড্রপ হয়েছে কি না।’’
প্রসঙ্গত, সরকারি নিয়মে প্রতি একশো কলে দু’টো ‘ড্রপ’ স্বাভাবিক। কিন্তু বাস্তবে হারটা এখন বিস্তর বেশি হয়ে গিয়েছে বলে কর্তারা স্বীকার করছেন।