বিয়ের আসরে ওয়াইস গিলানি ও ফইজা গিলানি। —নিজস্ব চিত্র।
দু’মাসে ৭২টা মৃত্যুর খবর! উত্তাল কাশ্মীরে লাগামহীন সেনা-জনতা সংঘর্ষ। সঙ্গে ভারত-পাক সম্পর্কের বিরামহীন কূটনৈতিক কাটাছেঁড়া আর দু’দেশের রাষ্ট্রনেতাদের তোপ-পর্বই এত দিন জায়গা করে নিয়েছে শিরোনামে। তবে কাশ্মীর উপত্যকার এই অন্ধকারে এক চিলতে রোশনাই এনে দিল একটি অভিনব বিয়ের অনুষ্ঠান! ৫৪ দিনের কার্ফুর জেরে যখন খবরের কাগজের পাতায় পাতায় বিয়ের অনুষ্ঠান বাতিলের বিজ্ঞাপন চোখে পড়েছে, ঠিক সেই সময়েই শ্রীনগরের এক পুলিশকর্মীর সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধলেন পাক অধিকৃত কাশ্মীরের বাসিন্দা এক তরুণী! ভূস্বর্গের দখল নিয়ে দু’দেশের টানাপড়েন আর দোষারোপ পর্ব ছাপিয়ে নতুন এক সম্পর্কে বাঁধা পড়ল কাশ্মীর উপত্যকা!
মঙ্গলবার রাতেই ছোট্ট একটা পারিবারিক অনুষ্ঠান করে বিয়ে করেছেন ওয়াইস গিলানি এবং ফইজা গিলানি। ওয়াইস জম্মু কাশ্মীর পুলিশের সাব ইনস্পেক্টর। থাকেন শ্রীনগরেই। আর ফইজার বাড়ি পাক অধিকৃত কাশ্মীরের মুজফ্ফরাবাদে। বিশেষ অনুমতি নিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে শ্রীনগরে এসেছে ‘বারাত’। তার পর শ্রীনগরের একটি হোটেলেই হয়েছে গাঁটবন্ধন। তবে দুই পরিবারই জানাচ্ছে, ওয়াইস-ফইজার বিয়েটা কিন্তু প্রেম করে নয়। বরং দুই পরিবারের ভাল সম্পর্কের জেরেই ছেলে-মেয়ের বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বাড়ির বড়রা। বিয়ে ঘিরে উৎসাহেরও অন্ত নেই তাঁদের। গত ৫৪ দিন ধরে কাশ্মীরের টালমাটাল পরিস্থিতিতে কপালে ভাঁজ পড়েছিল বটে। তবে আজ না হোক কাল, বিয়েটা যে হচ্ছে তা নিয়ে সংশয়ের কোনও অবকাশই ছিল না— একবাক্যে বলছে দুই পরিবার!
তবে পাক অধিকৃত কাশ্মীর থেকে শ্রীনগরে বিয়ে করতে আসার বিড়ম্বনাও নেহাত কম ছিল না! ফইজার এক আত্মীয়ের কথায়, ‘‘এক মাস আগে থেকেই বিশেষ অনুমতির ব্যবস্থা করতে হয়েছে। বারামুলা জেলার ‘আমন সেতু’ দিয়ে কাশ্মীরে ঢোকার অনুমতি ছিল আমাদের কাছে। সেখান দিয়েই আমন-বাসে চেপে ১২ জন আত্মীয়-বন্ধুকে নিয়ে ‘বারাত’ এসেছে ও-পার থেকে।’’ তার পর ছিমছাম বিয়ে। তবে ভোজের আয়োজনে কোনও ত্রুটি ছিল না! রীতি মেনে হয়েছে ‘ওয়াজান’ (মুরগি আর পাঁঠার মাংসের ঢালাও আয়োজন)।
তবে আক্ষেপ একটা রয়েই গিয়েছে। এমন একটা বিয়ের অনুষ্ঠান শুধু পরিস্থিতির কারণেই ছোট করে সারতে হল! ফইজার এক আত্মীয় বলছেন, ‘‘সে দিন অবশ্য এখানে সব শান্তই ছিল। আমরা তো ভেবেছিলাম জনা-তিরিশেক অতিথিকে নিয়ে আসব। কিন্ত একেবারে শেষ মুহূর্তে বাদ দিতে হল অনেককে। সে দিন অবশ্য সব শান্তই ছিল। তবুও কাশ্মীরের যা পরিস্থিতি! তাড়াতাড়ি এখানে শান্তি ফিরুক, এটাই চাই শুধু।’’ ফইজার পরিবারের মতোই আক্ষেপের সুর শোনা গেল ওয়াইসের বাড়িতেও। এক আত্মীয়ের কথায়, ‘‘আমরা তো খুব বড় করে বিয়ের উৎসব করব ভেবেছিলাম। ঈশ্বর চাইলেন না বোধহয়। আমন-সেতু দিয়ে যাতায়াতের অনুমতি জোগাড় করা খুব কঠিন কাজ। সেটা হয়ে গিয়েছিল বলে এখনই বিয়েটা সেরে ফেলার সিদ্ধান্ত হল। বিয়ে পিছিয়ে দেওয়ার কোনও প্রশ্নই ছিল না!’’
বিয়েটা ভালয় ভালয় হয়ে যাওয়ায় স্বস্তির হাসি ফিরেছে দুই পরিবারেই। দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব এ বার আত্মীয়তায় পাল্টে গিয়েছে। ‘‘আগের থেকে আরও ঘনঘন দেখা হবে এ বার দুই পরিবারের’’— হাসিমুখে বলছেন ফইজার এক আত্মীয়।
হাজার অশান্তির মধ্যেও কাশ্মীরের দুই প্রান্তের এমন বন্ধনের ছবিটাই আশার আলো ফিরিয়ে এনেছে শ্রীনগরে। নাই-বা হল প্রেম করে বিয়ে, এমন বিয়েটার মতো করেই যদি এ বার সংঘর্ষে ইতি টেনে একটু ভাব হয় দু’পক্ষের তাতেই বা কম কী— বলছে ফইজা-ওয়াইসের পরিবার!