আকচাআকচি এখন অতীত। বিমা বিল ঠেকাতে সংসদে নরেন্দ্র মোদী সরকারের বিরুদ্ধে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছে তৃণমূল ও সিপিএম। ফলে বিমা ক্ষেত্রে বিদেশি লগ্নির পরিমাণ ২৬ থেকে বাড়িয়ে ৪৯ শতাংশে নিয়ে যেতে কেন্দ্র মরিয়া হলেও এই বাধা টপকে তা কতটা করা সম্ভব, তা নিয়ে কিছুটা উদ্বেগে শাসক বিজেপি। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে একদা যুযুধান দুই দলের এই জোটকে কটাক্ষ করতেও ছাড়ছেন না বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব। দলের এক কেন্দ্রীয় নেতার কথায়, “বিজেপিকে ঠেকাতে, সংস্কারের পথ আটকাতে অতীতের দুই শত্রু এখন নব্য বন্ধু হয়েছে! নবান্নয় ফিশ ফ্রাই থেকে বিমা বিলে আপত্তি সবই এক সুরে বাঁধা!”
লোকসভায় বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জিতে এসেও নরেন্দ্র মোদীর সরকার আর্থিক সংস্কারের পথে প্রথম ধাক্কা খায় বিমা বিল নিয়েই। দেশীয় ও বিদেশি সংস্থাগুলির যৌথ উদ্যোগে তৈরি বিমা সংস্থায় এত দিন বিদেশি সংস্থাগুলি ২৬% পর্যন্ত লগ্নি করতে পারত। সেই লগ্নির ঊর্ধ্বসীমা এ বার ৪৯%-এ বাড়িয়ে নিয়ে যেতে বিল পাশ করাতে চাইছে সরকার। রাজ্যসভায় সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় বিল আটকে যায়। বিরোধীদের চাপে একে সংসদীয় সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানো হয়। ১৫ সদস্যের ওই সিলেক্ট কমিটির চেয়ারম্যান চন্দন মিত্র। ৪ সেপ্টেম্বর সিলেক্ট কমিটির প্রথম বৈঠকের পর কাল, শুক্রবার ফের বৈঠক ডাকা হয়েছিল। সেখানে ফের একজোট হয়ে তৃণমূলের ডেরেক ও’ব্রায়েন ও সিপিএমের পি রাজীব বিমা বিলের বিরোধিতা করেছেন। উল্টো দিকে বিজেপির তরফে বিলের পক্ষেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা তৈরি করে দ্রুত রিপোর্ট তৈরির কাজ শেষের চেষ্টা চলছে।
প্রথম দিন বেসরকারি বিমা সংস্থাগুলির বক্তব্য শোনার পরে গত কাল জীবন বিমা নিগম (এলআইসি) ও অন্যান্য রাষ্ট্রায়ত্ত জীবন বিমা সংস্থাকে ডাকা হয়েছিল। এলআইসি এর আগে সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে বিমা বিলে বিদেশি লগ্নির বিরোধিতা করেছে। কিন্তু কাল সিলেক্ট কমিটিতে তারাই বিদেশি লগ্নির পক্ষে সওয়াল করে। এলআইসি-র এই অবস্থান বদল নিয়ে কমিটির বিরোধী সদস্যরা প্রশ্ন তোলেন। স্থায়ী কমিটির সামনে তাঁদের কী অবস্থান ছিল, এখন কেন তাঁরা তাতে পরিবর্তন আনছেন, সেই বিষয়ে এলআইসি-র চেয়ারম্যান এস কে রায়কে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে।
২০০০ সালে বিমা ক্ষেত্রে প্রথম বিদেশি লগ্নির জন্য দরজা খুলে দেওয়া হয়। গত ১৪ বছরে বিমা ক্ষেত্রে ৭ হাজার ৭০০ কোটি টাকার বিদেশি লগ্নি এসেছে। বিরোধী দলের সদস্যদের প্রশ্ন, এই টাকা কী ভাবে কাজে লাগানো হয়েছে? এখন বিদেশি লগ্নির পক্ষে যুক্তি দেওয়া হচ্ছে, সাধারণ মানুষের কাছে জীবন বিমা পৌঁছে দিতে বিদেশি লগ্নি সহায়ক হবে। কিন্তু এত দিন বিদেশি লগ্নির অর্থ সেই কাজে লাগানো হয়েছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিরোধী দলের সদস্যরা। বিমা সংস্থা ছাড়াও অর্থ মন্ত্রক, আইন মন্ত্রক ও কর্পোরেট বিষয়ক মন্ত্রকের আমলাদের বক্তব্যও শোনা হয়। সূত্রের খবর, এর পর বিমা এজেন্টদের সংগঠন, কর্মচারী সংগঠন ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট মহলের বক্তব্য শোনা হবে। ডাকা হবে বিমা নিয়ন্ত্রক ও উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (আইআরডিএ)-কেও। তার পরে এ বিষয়ে সিলেক্ট কমিটিতে বিতর্ক হবে।
সিলেক্ট কমিটি যাতে বিলের পক্ষেই রায় দেয়, তা নিয়ে কমিটিতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা তৈরি করতে বিজেপি নেতৃত্ব যথেষ্ট তৎপর। তৃণমূল কংগ্রেস ও বামেদের পাশাপাশি কংগ্রেসের আনন্দ শর্মা, বি কে হরিপ্রসাদরাও সিলেক্ট কমিটিতে বিমা বিল নিয়ে বিরোধিতা করছেন। কিন্তু বাম-তৃণমূলের মতো আগাগোড়া বিরোধিতা করছেন না তাঁরা। জেটলি মনে করছেন, প্রধান বিরোধী দলগুলির মধ্যে ‘ইতিবাচক’ মনোভাব দেখা যাচ্ছে। বিজু জনতা দল আগেই সমর্থন জানিয়ে রেখেছে। সমাজবাদী পার্টি বিরোধিতা করছিল। কিন্তু শুক্রবারের বৈঠকে সপা-র সদস্য রামগোপাল যাদব অনুপস্থিত থাকায় তাঁর দলের অবস্থান কী হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সপা-র পক্ষ থেকে অবশ্য বলা হচ্ছে, উত্তরপ্রদেশে উপনির্বাচনের জন্য তিনি বৈঠকে যেতে পারেননি।
বিজেপি নেতৃত্ব বিমা বিল নিয়ে দেরি করতে চাইছেন না। সিলেক্ট কমিটির রিপোর্ট দ্রুত চূড়ান্ত করতে প্রতি সপ্তাহের শুক্রবার কমিটির বৈঠক ডেকেছেন চন্দন। আমজনতা এ বিষয়ে মতামত জানাতে চাইলে ২০ সেপ্টেম্বরের মধ্যেই তা করতে হবে। নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যেই কমিটির রিপোর্ট সংসদে পেশ করতে চাইছেন তিনি। অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি আগেই বলেছিলেন, চলতি বছরের শেষেই বিমা বিল পাশ হয়ে যাবে বলে আশা করছেন তিনি। আর চন্দনবাবু যে ভাবে প্রতি সপ্তাহে বৈঠক ডেকে কমিটির কাজ গুটোতে চাইছেন, তাতে বাকি সদস্যরা মনে করছেন, শীতকালীন অধিবেশনেই বিল পাশ করানোর বিষয়ে বদ্ধপরিকর সরকার।