দাউদ মুণ্ডা।
এখানে-ওখানে জলকাদা মাখা, ঘাস প্রায় উঠে যাওয়া ধূসর মাঠে ছুটছিলেন উনিশ বছরের সদ্য-যুবক। পাঁচ মিনিটে পেরোতে হবে ১৬০০ মিটার। মানে প্রায় একটা ফুটবল মাঠের চারপাক। সঙ্গে দৌড়চ্ছে আরও প্রায় দু’শো লোক। একটু ধাক্কাধাক্কিই হয়ে যাচ্ছে মাঝেমধ্যে। ও—ই দূরে দড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে দু’জন।
পাঁচ মিনিটের আগে দড়ি ছুঁতে হবে। যে দড়ির ও-পারে রয়েছে অনেক আশা-ভরসা। রয়েছে একটা চাকরির পরীক্ষায় প্রথম ধাপ পেরিয়ে যাওয়ার অদৃশ্য মেডেল। আর রয়েছে উনিশ বছরের ওই ছেলের দাদার স্বপ্ন। যে তাকে বলত, ‘‘আমার মতো তুই-ও আর্মিতে চাকরি করবি।’’
দাদা বাড়ি ফিরেছিল ক’দিন আগে। সেই শেষ ফেরা। নিয়ন্ত্রণরেখা-লাগোয়া উরির সেনাঘাঁটি থেকে তেরঙ্গা মোড়া কফিনে এসেছিল জঙ্গিদের সঙ্গে লড়াইয়ে প্রাণ দেওয়া দাদার দেহ। বিউগল আর গান স্যালুটে সেনাবাহিনী বিদায় দিয়েছিল ঝাড়খণ্ডের শহিদ জওয়ান জাবরা মুণ্ডাকে। ছোট ভাই তখন তুলে রেখেছিলেন দাদার স্বপ্নটুকু। আর তাই দাদার শেষকৃত্য মিটতে না মিটতেই অনেক পথ উজিয়ে ঝাড়খণ্ডের খুঁটি শহর থেকে চলে এসেছিলেন রাঁচি। সেনাবাহিনীতে ভর্তির পরীক্ষা দিতে। চাকরিটা হলে গরিব পরিবারে অভাব ঘুচবে। দাদাও খুশি হবে।
সেই চাকরিরই প্রথম পরীক্ষা ওই দৌড়। দৌড় পরীক্ষায় পাশ করলে আরও পরীক্ষা। একটার পর একটা। বলা বাহুল্য, সেগুলো হবে আরও কঠিন। ছুট ছুট...। আর তো একটুখানি।
আর ঠিক তখনই সব নিঃশ্বাস স্তব্ধ করে আচমকা সরিয়ে নেওয়া হল দড়িটা। পরীক্ষা শেষ!
ফিনিশিং লাইনের অদূরে দাঁড়িয়ে হাঁফাতে থাকেন উনিশ বছরের দাউদ মুণ্ডা। এ বার আর হল না!
শনিবার রাতে বহু চেষ্টার পর ফোনে পাওয়া গেল দাউদকে। তখনই বলছিলেন দৌড় পরীক্ষার গল্প। ওই দড়ি সরিয়ে নেওয়া, প্রথম দিকে ধাক্কাধাক্কিতে তাঁর একটু পিছিয়ে পড়া— সব। বললেন, ‘‘ফোনটার চার্জ শেষ হয়ে গিয়েছিল। এখানে আর কোথায় চার্জ দেব বলুন? এসে থেকে তো মোরাবাদি ময়দানের গাছতলায় থেকেছি। সেখানেই ঘুমিয়েছি।’’
গত কয়েক দিন ধরেই রাঁচির এই ময়দানে চলছে সেনাবাহিনীর চাকরির পরীক্ষা। ঝাড়খণ্ডের নানা প্রান্ত থেকে কয়েক হাজার পরীক্ষার্থী এসেছেন। ময়দানের সামনে এখন অস্থায়ী ভাতের হোটেল, অটোরিকশার জটলা— একটা মেলা যেন। সকালে সেখানেই দেখা হয়েছিল দাউদের সঙ্গে। সদ্য দাদার পারলৌকিক কাজকর্ম করেছেন বলে মাথা কামানো। কাঁধে ব্যাগ।
তখনই দাউদ জানিয়েছিলেন, এখনও মাঝেমধ্যে দাদার কথা ভেবে কান্নায় ডুকরে ওঠেন তাঁর মা। আর বৌদি বড়ই চুপচাপ হয়ে গিয়েছেন। ‘‘কিন্তু আমি ভয় পাইনি। আমি গর্বিত। দাদা আমাকেও সব সময়ে সেনাবাহিনীতে আসতে উৎসাহ দিত। ওর স্বপ্নটা সত্যি করতে চাই। তা ছাড়া, আমার ওপরেই তো এখন পুরো পরিবারের দায়িত্ব। খুব গরিব আমরা।’’— বলেছিলেন তিনি।
সালমি দেবীর দুই ছেলে। জাবরার মৃত্যুর পর ছোটটাও সেনাবাহিনীতে যেতে চায় শুনে ভয় পেয়েছিলেন মা। দাউদকে ছাড়তে চাননি। বারণ করেছিলেন বৌদি জাঙি দেবীও। দু’জনকে অনেক বুঝিয়ে পরীক্ষা দিতে দাউদ চলে আসেন মোরাবাদি ময়দানে। সঙ্গে কয়েক জন বন্ধু। সকলে ডেরা বাঁধেন গাছতলায়। দাউদ বলছিলেন, ‘‘মা, বৌদি, আত্মীয়রা বলেছিল, দাদার মৃত্যুর পরে সরকার থেকে যে টাকা পাওয়া গিয়েছে তার কিছুটা দিয়ে খুঁটিতেই একটা দোকান খুলতে।
আমি কিন্তু রাজি হইনি।’’
কিন্তু তার বদলে যে চ্যালেঞ্জটা নিলেন, সেটা পেরোতে পারবেন? দৌড় পরীক্ষাতেই তো অনেকে ছিটকে যান। দাউদ বলেছিলেন, ‘‘এই কঠিন পরীক্ষায় পাশ করেই তো দাদা সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিল। তা হলে আমি কেন পারব না?’’
একরাশ প্রত্যয় চোখেমুখে নিয়েই এর পর পরীক্ষা দিতে গিয়েছিলেন দাউদ। তার পর খবরটা দিলেন রাতে— ‘হয়নি।’
শহিদ জওয়ানের গরিব ভাইয়ের চাকরি পাওয়াটা কি দরকার ছিল না? বিশেষ করে এই উরিকে ঘিরেই যখন চলছে আন্তর্জাতিক টানাপড়েন। প্রসঙ্গটা তুলতে নৌবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ভাইস অ্যাডমিরাল পি কে চট্টোপাধ্যায় বললেন, ‘‘দেশের অন্যতম বড় সমস্যা বেকারত্ব। সেটাই বাস্তব। নিম্ন-মধ্যবিত্ত ঘর থেকে উঠে আসা যুবকদের কাছে সেই কারণেই সেনাবাহিনী হল কর্মসংস্থানের একটা বড় ক্ষেত্র। আসলে অনেক প্রতিষ্ঠানেই কর্মরত অবস্থায় কেউ মারা গেলে পরিবারে একটি চাকরি দেওয়া হয়। কিন্তু তা সেনাবাহিনীতে সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে শারীরিক পরীক্ষায় সক্ষম হতে হয়। ফলে শহিদ জওয়ানের ভাইকেও সেই পরীক্ষা দিয়েই বাহিনীতে ঢুকতে হবে।’’ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল অরুণ রায় বলছেন, ‘‘এখনও ভারতে কয়েকটি মাত্র প্রতিষ্ঠান আছে, যেখানে যোগ দিতে পারলে মানুষ গর্ববোধ করে। দেশের জন্য প্রাণ দেওয়াকে অন্য যে কোনও মৃত্যুর চেয়ে মর্যাদার বলে মনে করা হয়। সেই কারণেই এক ভাই শহিদ হওয়ার পরেও আর এক ভাই অবলীলায় সেনায় ভর্তি হতে চায়। মৃত্যুকে ভয় পায় না।’’
দাউদও তা-ই বলছেন— ‘‘এখন আমার বয়স উনিশ। আরও কয়েক বার সুযোগ পাব পরীক্ষা দেওয়ার। আমি হাল ছাড়ছি না।’’