উদারতা, ভিন্ন মতাদর্শকে এক সঙ্গে নিয়ে চলায় জুড়ি ছিল না বাজপেয়ীর। ছবি: পিটিআই।
এক বার, মাত্র এক বারই গলা তুলে রুষ্ট ভাবে কথা বলতে দেখেছিলাম তাঁকে। ১৯৭৭-এর মার্চ মাস। সবে বিদেশমন্ত্রী হয়েছেন। সাউথ ব্লকের ৪ নম্বর গেট দিয়ে মন্ত্রকে ঢোকার মুখে জওহরলাল নেহরুর একটি ছবি টাঙানো থাকত। বাজপেয়ী ঢুকতে গিয়ে দেখলেন ছবিটি নেই। আমি ঠিক পাশেই। গলা তুলে অত্যন্ত রুক্ষ ভাবে নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘‘কে সরাল এই ছবি? এখনই ছবি খুঁজে এনে যথাস্থানে রেখে দিন!’’
উদারতা, ভিন্ন মতাদর্শকে এক সঙ্গে নিয়ে চলায় তাঁর জুড়ি ছিল না। তবে নেহরুর সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্কের দিকটিও উল্লেখযোগ্য। ১৯৫৭-এ নির্বাচনে জিতে লোকসভায় আসার পর বাজপেয়ীর বক্তৃতা নেহরুর এতটাই ভাল লেগেছিল, তিনি জনে জনে ডেকে তা বলতেন। প্রাক্তন বিদেশসচিব এম কে রাসগোত্রর কাছে শুনেছি, নিউ ইয়র্কে রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ অধিবেশনে ভারতীয় প্রতিনিধি দলের সদস্য করে বাজপেয়ীকে পাঠিয়েছিলেন নেহরু। রাসগোত্রকে ডেকে বলে দিয়েছিলেন, ‘এই ছেলেটি খুবই সম্ভাবনাময়। বিভিন্ন দেশের কর্তাদের সঙ্গে এর আলাপ করিয়ে দেবেন।’
উনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার অনেক আগে থেকেই চাকরির সূত্রে তাঁর বিদেশনীতি পর্যবেক্ষণ করেছি। উনি যখন বিদেশমন্ত্রী হলেন, আমি তখন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বিদেশনীতি সংক্রান্ত উপদেষ্টা। রাশিয়া ও জার্মানিতে যখন সফর করেছেন আমি তখন সেই দেশগুলির রাষ্ট্রদূত। আজ অনুভব করি— রাশিয়ার দিকে ঝুঁকে না-থেকে যে ‘প্রকৃত জোট নিরপেক্ষ’ অবস্থানের পক্ষে অটল সওয়াল করতেন, তা কতটা বাস্তবমুখী ছিল। পরে ইন্দিরা গাঁধী থেকে মনমোহন সরকার— সবাই রাশিয়ার পাশাপাশি আমেরিকার সঙ্গেও সমান্তরাল সম্পর্ক গড়েছে। অর্থাৎ বাজপেয়ীর ‘প্রকৃত জোট নিরপেক্ষতা’র পথেই হেঁটেছে। ইন্দিরা গাঁধী ’৮২ সালে ক্ষমতায় ফেরার পর প্রথম যে দেশটি সফরে গিয়েছিলেন সেটা আমেরিকাই! ইউপিএ-র প্রথম দফায় প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় আমেরিকায় গিয়ে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে যে কৌশলগত গাঁটছড়া বেঁধে এসেছিলেন, তার ধারাবাহিকতা এখনও চলছে।
একটা কথা বাজপেয়ী প্রায়ই বলতেন। ‘প্রতিবেশীদের সঙ্গে মিলেমিশে চলতেই হবে, কারণ প্রতিবেশী বেছে নেওয়ার সুযোগ আমাদের নেই।’ এ কথাও বলতেন, ‘‘ভারতের মতো এত বিচিত্র প্রতিবেশীও খুব কম দেশের রয়েছে। ভুটান থেকে শ্রীলঙ্কা, নেপাল থেকে পাকিস্তান— এক এক রাষ্ট্রের এক এক চরিত্র। ফলে নিজেদের দেশের মডেলকে অন্য দেশে চাপিয়ে দেওয়ারও সুযোগ নেই। প্রত্যেকের সঙ্গে পৃথক ভাবে কূটনৈতিক দৌত্য চালাতে হবে।’’ আজ মনে হয়, তখন যে প্রতিবেশী চ্যালেঞ্জ ছিল না— এমন নয়।
কিন্তু অটল ভাবে তার মোকাবিলা করেছিলেন বাজপেয়ী। সব সময় আলোচনার দরজা খোলা রাখার কথা বলতেন। লাহৌরের বাসযাত্রার পর কার্গিল হল। তার পরেও আলোচনার পরিসর রেখেছেন। সংসদ আক্রান্ত হল। তা-ও হাল ছাড়েননি। বাজেপয়ীর বিদেশনীতির আরও একটি দিক আমার কাছে খুবই আকর্ষণীয়। তা হল, শক্ত হাতে জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টিকে নিশ্চিত করা, প্রয়োজনীয় চাপ তৈরি করা। পাশাপাশি আলোচনার পথ খোলা রাখা, বন্ধুত্বপূর্ণ কূটনীতির রাস্তা নেওয়া।
কূটনৈতিক বৈঠকের সময় খুব ভেবেচিন্তে কথা বলতেন বাজপেয়ী। সময় নিয়ে কথা বলতেন। একটা মজার ঘটনা মনে পড়ছে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ব্রিটেনে গিয়েছেন তিনি। ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ব্লাঙ্কেট তখন একেবারেই চোখে দেখতে পান না। দু’জনে বসেছেন বৈঠকে। ডেভিড কিছু বলার পর অনেক ক্ষণ নীরবতা। অস্থির হয়ে উঠলেন ব্রিটিশ মন্ত্রী। বলেই ফেললেন, ‘ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী কি উঠে গেলেন নাকি!’ আসলে
উত্তর দিতে স্বভাবসুলভ দীর্ঘ সময় নিচ্ছিলেন বাজপেয়ী।
১৯৭৭ দিয়ে শুরু করেছিলাম, সেখানেই শেষ করি। ওই বছর বিদেশমন্ত্রী হিসেবে হায়দরাবাদ হাউসে আইএফএস অফিসারদের দেওয়া বক্তৃতায় বাজপেয়ী বলেছিলেন, ‘এই পেশায় ব্রাহ্মণভোজন এবং বক্তৃতা দেওয়া তো থাকবেই! তবে তার থেকেও বেশি কিছু করতে হবে আপনাদের।’
কথাটি আমি কখনও ভুলিনি।