ওয়েটারের ছেলে প্রথম, দোকানির ছেলে দ্বিতীয়

বাবা পানশালার ওয়েটার। মাস গেলে রোজগার পাঁচ হাজার টাকা। বৃষ্টি হলেই টিনের ছাদ গলে পড়া জল থেকে বাঁচতে গোটা পরিবার এক কোণে গুটিসুটি। গৃহশিক্ষক দূর অস্ত্। পড়ার টেবিলই ছিল না। এমন পরিবারের সন্তানের কাছে মেধা তালিকায় নাম তোলা অলীক কল্পনা, লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার জেদটাই তো অন্যায় আবদার! তবু অটল ছিল সরফরাজ হুসেন।

Advertisement

রাজীবাক্ষ রক্ষিত

গুয়াহাটি শেষ আপডেট: ০১ জুন ২০১৬ ০৩:০৬
Share:

মা-বাবার সঙ্গে সরফরাজ হুসেন। মঙ্গলবার উজ্জ্বল দেবের তোলা ছবি।

বাবা পানশালার ওয়েটার। মাস গেলে রোজগার পাঁচ হাজার টাকা। বৃষ্টি হলেই টিনের ছাদ গলে পড়া জল থেকে বাঁচতে গোটা পরিবার এক কোণে গুটিসুটি। গৃহশিক্ষক দূর অস্ত্। পড়ার টেবিলই ছিল না। এমন পরিবারের সন্তানের কাছে মেধা তালিকায় নাম তোলা অলীক কল্পনা, লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার জেদটাই তো অন্যায় আবদার! তবু অটল ছিল সরফরাজ হুসেন। আর অনড় ছিলেন তাঁর বাবা আজমল হুসেন। দারিদ্র তুচ্ছ করে স্বপ্ন দেখতেন ছেলেকে এক দিন বিখ্যাত করে তুলবেনই। স্বপ্ন সফল হওয়ার দিনে, অসমের এইচএসএলসি পরীক্ষায় প্রথম স্থানাধিকারী সরফরাজের পরিবার কেঁদেই চলেছে। আনন্দাশ্রু! লাজুক ছেলেটা যে একেবারে এক নম্বর জায়গাটা দখল করতে পারবে তা ভাবতেই পারছে না কেউ!

Advertisement

সরফরাজ নামের অর্থ ‘রাজা’। গুয়াহাটির জ্যোতিকুচি এলাকায়, পাহাড় ভেঙে কিছুটা উঠে ইটের দেওয়াল আর ভাঙা টিনের চালের একটি বাড়িই সরফরাজের ‘প্রাসাদ’। নামের অর্থটা ১৫ বছর ধরে যেন সরফরাজকে ব্যঙ্গ করেছে। উর্দুতে সরফরাজ কথার অপর অর্থ ‘উচ্চে আসীন ব্যক্তি’। আজ এইসএসএলসিতে প্রথম হওয়ার পরে নামের দ্বিতীয় অর্থটা অন্তত সত্যি করে দেখাতে পেরেছে ছেলেটা।

ফল বেরনোর পর থেকে হুসেন পরিবারে শুধুই সংবর্ধনা, প্রশংসার বন্যা। ক্যামেরার ঝিলিক। চ্যানেলের টানাটানি। তার মধ্যেই মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়াল আর শিক্ষামন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মার ফোন! আজমল হুসেন ও তাঁর স্ত্রী কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘‘ছেলেটা মুখ ফুটে কোনও দিন কিছু চায়নি। আজ আমাদের এত সম্মান দিল। কিন্তু ওর জন্যে সে ভাবে কিছুই করতে পারিনি। পারবও না।’’

Advertisement

কী করেই বা করবেন? আজমল ফ্যান্সি বাজার এলাকার পানশালায় কাজ করেন সামান্য বেতনে। আসতে-যেতে গাড়ি ভাড়াই অনেক। উপরি রোজগারের আশায় বাড়িতে পোষেন ছাগল। কিন্তু কিছুতেই ছেলে-মেয়ের পড়া বন্ধ হতে দেননি। বড় মেয়ে এখন আর্য কলেজে পড়ছে। তিনি বলেন, ‘‘সরফরাজ ছোট থেকেই ক্লাসে প্রথম হয়। টিভিতে প্রতি বছর যখন দেখতাম ম্যাট্রিকে প্রথম-দ্বিতীয় হওয়া ছেলেমেয়েদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়, আমিও স্বপ্ন দেখতাম একদিন সরফরাজকে নিয়েও তেমনই হবে।’’

স্বপ্ন দেখা আর তা সফল করার মধ্যে বিস্তর দেওয়াল ছিল। ছেলের পড়ার জন্য সামান্য টেবিলও কিনে দিতে পারেননি। দিতে পারেননি ভাল পোশাক। কিন্তু কখনও অভিযোগ করেনি সে। পানশালায় পড়ে থাকা পুরনো একটি টেবিল মালিকের কাছ থেকে চেয়ে এনেছিলেন। সেই টেবিল থেকেই ইতিহাস গড়ল সরফরাজ। তার প্রাপ্ত নম্বর, জেনারেল সায়েন্সে ১০০, ইংরাজিতে ৯৭, অঙ্কে ৯৯, অসমীয়ায় ৯৭, সোশ্যাল সায়েন্সে ৯৮। ভবিষ্যতে ডাক্তার হতে চায় সে।

সরফরাজের লড়াইয়ের কথা জেনে শিক্ষামন্ত্রী হিমন্ত ঘোষণা করেন, তাঁর জন্য সরকার পাঁচ লক্ষ টাকা ফিক্সজ ডিপোজিট করে দেবে। সে কটন কলেজে পড়তে চায়। তার যাবতীয় খরচ সরকারের। তার স্কুলকেও দেওয়া হবে ১০ লক্ষ টাকা। এমন কী মূল রাস্তা থেকে স্কুলে যাওয়ার ভাঙাচোরা রাস্তাও সরকার অবিলম্বে মেরামত করে দেবে।

ডিব্রুগড় সেন্ট জেভিয়ার্সের স্বাগত গগৈ প্রথম স্থান পাওয়া সরফরাজের থেকে মাত্র দু’নম্বর কম পেয়েছে। তবে সে বলে, ‘‘দ্বিতীয় হওয়ায় দুঃখ নেই। আমি তো প্রথম ২০ তে থাকবই ভাবিনি। আপাতত বিজ্ঞান নিয়ে পড়ব। পরে একজন ভাল চিকিৎসক হতে চাই।’’ বাবা নিরঞ্জন গগৈয়ের পাড়ায় মুদির দোকান আছে। বাবা-মার সঙ্গে মিলন নগর এলাকায় থাকা স্বাগতের প্রিয় বই রামায়ণ-মহাভারত আর রজনীকান্ত বরদলৈয়ের লেখা প্রথম অসমীয়া প্রকাশিত উপন্যাস ‘মিরি জিয়রি’। ফেসবুক বা হোয়াট্সঅ্যাপ থেকে দূরত্ব বজায় রাখা স্বাগত অবসর সময় বাবা-মার সঙ্গে ঢোল, তবলা, বাঁশি বাজায়। শিখছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত। কুইজ ও বিতর্কেও অংশ নেয় সে।

বরপেটার শঙ্করদেব বিদ্যা নিকেতনের দুই ছাত্র ভার্গব কাশ্যপ ও বিক্রমজিৎ দেউরি তৃতীয় হওয়ায় স্কুলের শিক্ষকরাও বাক্যহারা। তারা দু’জনেও ভবিষ্যতে ডাক্তার হতে চায়। মরিগাঁও শঙ্করদেব বিদ্যা নিকেতনের ছাত্রী আসমা ইয়াসমিন মেয়েদের মধ্যে প্রথম ও সব মিলিয়ে পঞ্চম হয়েছে। আসমার বাবা পুলিশকর্মী। মরিগাঁওপুলিশ কলোনির বাসিন্দা আসমা টেস্টের পরে ১৫-১৬ ঘণ্টা পড়ত। সেও ডাক্তার হতে চায়। সেবা করতে চায় চিকিৎসা না পাওয়া গ্রামবাসীদের।

অন্য দিকে, যোরহাট জেলার বাগচুং ডন বসকোর ছাত্র তৃষভ বরদলৈ পরীক্ষার পরেই খুন হয়ে যায়। সে ৮০ শতাংশ নম্বর পেয়ে পাশ করেছে। অঙ্কে পেয়েছে ১০০। মেধাবী ছাত্র হওয়ার পাশাপাশি তৃষভ ছিল সাব-জুনিয়র পর্যায়ের জাতীয় সাঁতারু ও স্কুলের ক্রিকেট দলের ক্যাপ্টেন। ১৭ মার্চ নিজের বাড়িতেই তার রক্তাক্ত দেহ মেলে। তার মাথার পিছনে গভীর ক্ষত ছিল। ডান হাতের তিনটি আঙুল ভাঙা ছিল। বাবা ও মা দু’জনেই অধ্যাপক। তাঁরা নিশ্চিত ছিলেন, ছেলে ভাল ফল করবে। আজ ফল বেরনোর পরে তৃষভের পরিবার ও স্কুলে ছিল দুঃখের ছায়া। দু’মাসের বেশি কেটে গেলেও পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করতে না পারায় হতাশ তৃষভের বাবা-মা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন