শোকার্ত: নিহত আনসারের মা ও পরিবার। চাকুলিয়ায়। নিজস্ব চিত্র
সকাল একটু গড়াতেই খবর পৌঁছে গেল গ্রামে। কান্নার শব্দে ভেসে গেল এলাকা। ভোর রাতে নয়াদিল্লিগামী সীমাঞ্চল এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন উত্তর দিনাজপুরের চাকুলিয়া এলাকার প্রত্যন্ত কামাত গ্রামের বাসিন্দা আনসার আলম (১৮), সামসুদ্দিন (২৫) এবং সাহেদা খাতুন (৪৫)। তিন জনের বাড়িই কাছাকাছি।
গ্রামের বাসিন্দা আজিজার রহমান জানালেন, ভিন্ রাজ্যে কাজ করার জন্যই গিয়েছিলেন গ্রামের মোট দশ জন। তিন জন মারা গিয়েছেন। বাকিরা আহত। উত্তর দিনাজপুর ছাড়াও, আশেপাশের আরও কয়েকটি জেলার অনেকেও ওই ট্রেনে উঠেছিলেন। তাঁদের বাড়ির লোকও রেলের কাছ থেকে খবর পেতে উদগ্রীব হয়ে রয়েছেন। অনেকে হাজিপুর, পটনা যেতে বেরিয়ে পড়েছেন।
আনসার দশম শ্রেণির ছাত্র। সে এইবারই প্রথম ভিন্ রাজ্যে কাজ করতে যাচ্ছিল। একই গ্রামের সামসুদ্দিন তিন বছর ধরে পানিপথে কাজ করতেন। সাহেদার দুই ছেলে হরিয়ানায় কাজ করেন। তিনি ছেলেদের কাছেই যাচ্ছিলেন। রবিবার সকালে আনসারদের সঙ্গী জাহিদুর প্রথমে ফোনে গ্রামে দুর্ঘটনার খবর জানান। সেই খবরই সঙ্গে সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে। কান্নায় ভেঙে পড়েন আনসারের মা কানিজ ফাতেমা। ফতেমা বলেন, ‘‘ছেলেকে নিষেধ করেছিলাম। বলেছিলাম, এখন যেতে হবে না। কিন্ত কথা শুনল কই। ছেলের নাকি কাজ হাত ছাড়া হয়ে যাবে। তাই গ্রামের অন্যদের সঙ্গে পাড়ি দিয়েছিল। এখন ওই আমার কোল ছাড়া হয়ে গেল।’’
আনসারের বাবা আব্দুল রাজ্জাক পেশায় দিনমজুর। আনসাররা চার ভাই এক বোন। আনসারই ছোট। আনসারের দুই ভাই আলাদা থাকেন। আর এক ভাই ভিন্ রাজ্যে কাজ করেন। পরিবার সূত্রের খবর, বাড়িতে অভাবের সংসার। আর সেই জন্যই স্বাবলম্বী হতে পড়াশোনা ছেড়ে কাজের সন্ধানে পাড়ি দিয়েছিল আনসার।
সামসুদ্দিনের মৃত্যুতে ভেঙে পড়েছেন তাঁর বোন আফলিন। অষ্টম শ্রেণিতে পড়াশোনা করে আফলিন। তাদের বাবা মা নেই। চার ভাই বোন। ভাইয়েরা সবাই আলাদা। সামসুদ্দিনের উপরেই দায়িত্ব বোন আফলিনের। তাঁদেরও অভাবের সংসার। তাই তিন বছর ধরে ভিন্ রাজ্যে কাজ করতে
বাধ্য হন সামসুদ্দিন। আফলিন বলে, ‘‘দাদা এক মাস আগে বাড়ি এসেছিলেন। আবার গেলেন। বলেছিলেন, ইদের সময় ফিরবে। এখন তো আর কোনওদিন ফিরবেন না। এখন আমার কী হবে?’’
এই একই প্রশ্ন এলাকার বহু পরিবারের। অনেকের বাড়ির ছেলেরাই ভিন্ রাজ্যে কাজ করেন। কখনও কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনার শিকার হতে হয়। কখনও কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার সময়। সাহেদার বোন রহিমা খাতুন বলেন, ‘‘বাইরে যেতেই হবে আমাদের ঘরের ছেলেদের। আর তার পর অপেক্ষা। কখনও সুসংবাদ আসে, কখনও দুঃসংবাদ।’’