যতটা ঢক্কানিনাদ, ততটাই কি বাস্তব!
নরেন্দ্র মোদী সরকার বিদেশি লগ্নির পথে লাল কার্পেট পেতে দেওয়ার পরে চব্বিশ ঘণ্টা কেটে গিয়েছে। ইতিমধ্যে সরকারের সিদ্ধান্ত খুঁটিয়ে দেখে শিল্পকর্তা থেকে শুরু করে অর্থনীতিবিদ— অনেকেই প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন, লগ্নির দরজা হাট করে দেওয়ার এই সিদ্ধান্তই কি অর্থনীতির হাল ফেরাতে যথেষ্ট? না কি আরও কাজ বাকি রয়েছে!
একটা বিষয়ে সকলে একমত যে লগ্নির সহায়ক পরিবেশ তৈরি করতে সঠিক পথেই হাঁটছে মোদী সরকার। কিন্তু একই সঙ্গে তাঁদের বক্তব্য, কাঠামোগত সংস্কার করতে হলে এখনও অনেকটা পথ হাঁটতে হবে।
গত কাল প্রতিরক্ষা, ওষুধ, খুচরো ব্যবসার ক্ষেত্রে বিদেশি লগ্নির ছাড়পত্র দেওয়াকে সব থেকে যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত বলে দাবি করেছিলেন মোদী সরকারের মন্ত্রীরা। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে বিদেশি লগ্নির শিকল আগের তুলনায় কিছুটা শিথিল হলেও এখনও অনেক শর্ত রয়ে গিয়েছে। এক ব্র্যান্ডের খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। কিন্তু শুধুমাত্র দেশে উৎপাদিত খাদ্যপণ্য বিক্রির জন্য। আর যে সব শর্ত শিথিল করা হয়েছে, তাতেও লাভ হবে শুধু অ্যাপল সংস্থার। একই ভাবে ওষুধ শিল্পের ক্ষেত্রেও মোদী সরকারের নীতি পরীক্ষার মুখে না-পড়া পর্যন্ত তাকে পাশ নম্বর দেওয়া উচিত হবে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে বিদেশ লগ্নির পথ খুলে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আসবে কি না, প্রশ্ন রয়েছে তা নিয়েও। মনমোহন সিংহের সরকার প্রতিরক্ষায় ২৬ শতাংশ পর্যন্ত সরাসরি বিদেশি লগ্নির অনুমোদন দিয়েছিল। ‘অত্যাধুনিক’ প্রযুক্তির সমরাস্ত্র হলে আরও বেশি লগ্নির পথ খোলা ছিল। তবে সরকারি অনুমোদন সাপেক্ষে। মোদী সরকার এসে সরাসরি লগ্নির পরিমাণ ২৬ থেকে বাড়িয়ে ৪৯ শতাংশ করে। তাতেও লাভ হয়নি। গত দেড় বছরে মোটে এক কোটি টাকার বিদেশি লগ্নি এসেছে। যার সব থেকে বড় কারণ হল, দেশীয় সংস্থাগুলির কাছে বিদেশি সংস্থাগুলির সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে যাওয়ার মতো প্রযুক্তি ছিল না। আবার, পুরোপুরি মালিকানা না-পাওয়া পর্যন্ত কোনও বিদেশি সংস্থাই নিজস্ব প্রযুক্তি নিয়ে আসতে চায়নি। অথচ বিদেশি সংস্থাগুলি বহু দিন ধরেই এ দেশে কারখানা খুলতে আগ্রহী। আবার মোদী সরকারও চায়, কোটি কোটি ডলার খরচ করে বিদেশ থেকে যুদ্ধাস্ত্র আমদানি না-করে দেশেই তা তৈরি করতে।
এ বার সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ‘আধুনিক’ প্রযুক্তি হলেই ৪৯ শতাংশের বেশি বিদেশি লগ্নির অনুমোদন মিলবে। বিশেষজ্ঞদের একাংশের প্রশ্ন, ‘অত্যাধুনিক’ থেকে ‘আধুনিক’— এটুকু শর্ত শিথিল হলে কতখানি সাফল্য আসবে তা নিয়েই। তাঁদের মতে, সবটাই নির্ভর করবে বাস্তবে সরকার কী মনোভাব নিচ্ছে তার উপরেই। সরকার যদি দরাজ হাতে ছাড়পত্র দিতে শুরু করে, তা হলেই লগ্নি আসা সম্ভব।
ওষুধ শিল্পের ক্ষেত্রে সংশয়ের জায়গা হল, শুধুমাত্র নতুন প্রকল্পের জন্য ১০০ শতাংশ বিদেশি লগ্নির অনুমোদন দেওয়া। চালু প্রকল্পের ক্ষেত্রে ৭৪ শতাংশ পর্যন্ত বিদেশি লগ্নির ক্ষেত্রে সরকারি কোনও অনুমোদন লাগবে না। কিন্তু তার চেয়ে বেশি লগ্নি টানতে গেলেই অনুমোদন আবশ্যিক। ৭৪ শতাংশ মালিকানা কিনতে বিদেশি সংস্থাগুলি কতটা উৎসাহ দেখাবে, তা নিয়ে এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের সংশয় রয়েছে।
খাদ্যপণ্যের সরাসরি বা অনলাইন বেচাকেনাতেও একশো ভাগ বিদেশি লগ্নির অনুমোদন দিয়েছে মোদী সরকার। শর্ত একটাই। সেই সব খাদ্যপণ্য দেশেই উৎপাদন হতে হবে। সমস্যা হল, যে সব সংস্থা খাদ্যপণ্য বেচাকেনার ব্যবসা করে, তারা একই সঙ্গে নিত্য প্রয়োজনীয় বা মুদির দোকানের জিনিসপত্রও বিক্রি করে। খাবারের সঙ্গেই বিক্রি হয় সাবান-শ্যাম্পু। এখন তাদের বিদেশি লগ্নি টানতে গেলে দু’টি ব্যবসা আলাদা করতে হবে। কারণ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির ছাড়পত্র দেওয়া হয়নি।
তা ছাড়া, ওয়ালমার্ট বা আমাজনের মতো সংস্থাগুলি অনলাইনে খাদ্যপণ্য বিক্রি শুরু করলে তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে আপত্তি উঠতে পারে। কংগ্রেস, সিপিএম, তৃণমূলের পাশাপাশি সঙ্ঘ পরিবারের বিএমএস ইতিমধ্যেই বিদেশি লগ্নির সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছে। বিএমএসের দাবি, অবিলম্বে সব দলের বৈঠক ডাকুক কেন্দ্র। এই বিরোধিতাকে সংসদে, বিশেষ করে যেখানে সরকার সংখ্যালঘু, সেই রাজ্যসভায় সামাল দিতে হবে। লগ্নিকারীদের আস্থা অর্জনের থেকে সেটা কম বড় চ্যালেঞ্জ নয়।