গদি অনিশ্চিত, তবু হাসিমুখে শপথ নিলেন ইয়েদুরাপ্পা

কংগ্রেস বলছে, যা করার করে নিন ইয়েদুরাপ্পা। মাত্র একদিনের মুখ্যমন্ত্রী তিনি। আগামিকালই সুপ্রিম কোর্টে ফের শুনানি। সেখানেই বদলে যাবে তাঁর এক রাতের ভাগ্য।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১৮ মে ২০১৮ ০৩:৫৪
Share:

দায়িত্ব: শপথ নিচ্ছেন ইয়েদুরাপ্পা। রয়েছেন কর্নাটকের রাজ্যপাল বজুভাই বালা। ছবি: পিটিআই।

মাথার উপর আদালতের খাঁড়া। তবু হাসিমুখেই একা একা শপথ নিলেন ইয়েদুরাপ্পা। কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে।

Advertisement

যে শপথে গেলেন না প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ। সাম্প্রতিক অতীতে অন্য মুখ্যমন্ত্রীদের বেলায় মোদী টুইট করে অভিনন্দন জানালেও ইয়েড্ডির তা জুটল না। কিন্তু তাতে কী। আজ একাই শপথ নেওয়ার পরে ইয়েদুরাপ্পা একাই মন্ত্রিসভার বৈঠকও সারলেন! সেখানে ভোট প্রতিশ্রুতি মেনে কৃষিঋণ মকুব নিয়ে আলোচনা করলেন আমলাদের সঙ্গে। তার পরেই প্রথম কাজ করলেন প্রশাসনিক রদবদল। বদলালেন গোয়েন্দা কর্তা, এজি-সহ একাধিক শীর্ষ কর্তাকে। কংগ্রেসের বিধায়করা যে হোটেলে রয়েছেন, সেখানকার নিরাপত্তা ছাঁটলেন। পরিস্থিতি বুঝে রাতেই দলের বিধায়কদের কেরলের কোচিতে নিয়ে যেতে সক্রিয় হয় কংগ্রেস। কিন্তু অনুমতি না মেলায় রাতেই বাসে করে বিধায়কদের কেরলে সরিয়ে নিচ্ছে তারা।

কংগ্রেস বলছে, যা করার করে নিন ইয়েদুরাপ্পা। মাত্র একদিনের মুখ্যমন্ত্রী তিনি। আগামিকালই সুপ্রিম কোর্টে ফের শুনানি। সেখানেই বদলে যাবে তাঁর এক রাতের ভাগ্য।

Advertisement

সুপ্রিম কোর্টের ছয় নম্বর এজলাস

অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি: আজ কংগ্রেস-জেডি(এস) রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা…

বিচারপতি বোবদে: গত কাল, মিস্টার সিঙ্ঘভি, গত কাল! এখন আজ, নতুন দিন।

সিঙ্ঘভি: ওহ, হ্যাঁ। গত কাল রাত ৯টায় রাজ্যপাল ইয়েদুরাপ্পাকে চিঠি পাঠিয়েছেন, আজ সকালে শপথ নেওয়ার জন্য। ১১৬ জনের জোটের আগে ১০৪ জনের দলকে ডেকে ১৫ দিন সময় দেওয়ার অর্থ হল ক্ষতে নুন ছেটানো। সরকারিয়া কমিশন বলেছে, প্রথমে প্রাক-নির্বাচনী জোট, তার পরে একক বৃহত্তম দল, তার পর নির্বাচন-পরবর্তী জোটকে ডাকার কথা।

বিচারপতি সিক্রি: আপনি বলছেন, আপনারা (কংগ্রেস) তিন নম্বরে। কিন্তু ওরা (বিজেপি) দু’নম্বরে নয়!

সিঙ্ঘভি: বহু ক্ষেত্রে একক বৃহত্তম দলের বদলে নির্বাচন পরবর্তী জোটকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। গোয়া, মেঘালয়, মণিপুর, দিল্লি, ঝাড়খণ্ড, জম্মু-কাশ্মীর। গোয়ায় কংগ্রেস একক বৃহত্তম দল ছিল।

মকুল রোহতগি: গোয়ায় কংগ্রেস সরকার গঠনের দাবিই জানায়নি। তাই বিজেপিকে ডাকা হয়।

সিঙ্ঘভি: আমি শুনলাম, ইয়েদুরাপ্পা ৭ দিন চেয়েছিলেন, রাজ্যপাল ১৫ দিন দিয়েছেন। এটা অন্যের দল ভাঙানোর জন্য সবথেকে বড় লাইসেন্স।

বিচারপতি বোবদে: আদালতের কি আদৌ রাজ্যপালকে নিরস্ত করার কথা ভাবা উচিত?

সিঙ্ঘভি: যদি রাষ্ট্রপতি শাসনে আদালত স্থগিতাদেশ জারি করতে পারে, তা হলে রাজ্যপালের সিদ্ধান্ত নিয়েও বিচার হতে পারে।

বিচারপতি বোবদে: বিচার নয়। প্রশ্ন হল, রাজ্যপালের নির্দেশে স্থগিতাদেশ জারি করা যাবে কি না?

সিঙ্ঘভি: রাজ্যপাল ১০ জন বিধায়কের দলকে ডেকে সকাল ন’টায় শপথ নেওয়ালেও হুজুররা কি বলবেন, রাজ্যপালের কাজে স্থগিতাদেশ হয় না? শপথগ্রহণ পিছিয়ে দিন। তাতে রাজ্যপালের পদক্ষেপে লাগাম পরানো হবে না।

বিচারপতি সিক্রি: বিজেপির লেখা চিঠিটাই তো সামনে নেই। তা হলে কী করে আমরা নাক গলাতে পারি?

(বিচারপতিরা নিজেদের মধ্যে দীর্ঘক্ষণ আলোচনা করলেন)

সিঙ্ঘভি: সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণের সময় কমিয়ে ২ দিন করা হোক। ঝাড়খণ্ড, গোয়া, উত্তরপ্রদেশে সুপ্রিম কোর্ট ়সময় কমিয়ে ১৫ দিন থেকে ৪৮ ঘণ্টা করে দিয়েছিল।

কে কে বেণুগোপাল: এখানে সব যুক্তি আন্দাজের ভিত্তিতে দেওয়া হচ্ছে। গোটাটাই অস্পষ্ট।

রোহতগি: এই মাঝরাতে এ সবের দরকারই ছিল না। সকালে কেউ শপথ নিলে আকাশ ভেঙে পড়ত?

বিচারপতি সিক্রি: আগে বলুন, কী ভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতার দাবি করছেন?

বেণুগোপাল: ইয়েদুরাপ্পা চিঠিতে কী দাবি করেছেন, সেটা অজানা।

বিচারপতি সিক্রি: কংগ্রেস-জেডি(এস)-এর ১১৭ জন সই করেছেন। তা হলে বিজেপি কী ভাবে ১১৩ জনের সমর্থন দাবি করে?

বেণুগোপাল: সব কিছুই পরে উল্টে ফেলা যেতে পারে। ১৫ দিন অপেক্ষা করতে সমস্যা কী?

বিচারপতি বোবদে: এটা আর এক প্রশ্ন। ১৫ দিনের অপেক্ষা কেন?

বেণুগোপাল: এটা রাজ্যপালের সিদ্ধান্ত। শপথের আগে দলত্যাগ বিরোধী আইন কার্যকর হয় না।

বিচারপতি সিক্রি: এটা উদ্ভট যুক্তি। এ কথা বলা মানে ঘোড়া কেনাবেচায় খোলাখুলি আমন্ত্রণ জানানো।

রোহতগি: রাজ্যপালের কাজের আইনি বিচার হতেই পারে। কিন্তু তাঁর কাজে স্থগিতাদেশ দেওয়া যায় না। প্রশ্ন উঠল, ইয়েদুরাপ্পার আইনজীবী কে? রোহতগি জানালেন, তিনি ইয়েদুরাপ্পার আইনজীবী নন। কয়েক জন বিজেপি বিধায়কের আইনজীবী।

সিঙ্ঘভি: যদি ইয়েদুরাপ্পার চিঠিতে দেখা যায়, তাঁর পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই? সন্ধ্যাবেলা শপথগ্রহণ হোক।

রোহতগি: আদালত রাজ্যপালকে তাঁর সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে বাধা দিতে পারে?

সিঙ্ঘভি: অদ্ভুত বিষয় যে রোহতগি বিজেপি বিধায়কদের হয়ে সওয়াল করছেন, তবু সকালেই ইয়েদুরাপ্পার শপথ চাইছেন।

রোহতগি: আমার যার খুশি, তার হয়ে সওয়াল করব।

সিঙ্ঘভি: শপথগ্রহণ বিকেল সাড়ে চারটে পর্যন্ত পিছিয়ে দিন। ইয়েদুরাপ্পা তার মধ্যে চিঠি নিয়ে আসুন। যদি আদালত দেখে, আমার মামলায় যুক্তি নেই, তা হলে বেরিয়ে যাব।

বেণুগোপাল: শপথগ্রহণ হলে এমন কিছু অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে না। সব ক্ষতিই মেরামত সম্ভব।

রোহতগি: সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণে ১৫ দিন সময় দেওয়া ঠিক কি না, তা নিয়ে আগামী দু’-তিন দিন বিচার হতে পারে। ইয়াকুব মেমনের মামলায় রাত দু’টো থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত শুনানি হয়েছিল। কারণ লোকটার ভোর ৬টায় ফাঁসি হওয়ার কথা ছিল। এখানে এত তাড়াহুড়ো কিসের?

অনুপ চৌধুরি (কংগ্রেসের আর এক আইনজীবী): এখানে সংবিধানকে ফাঁসিতে ঝোলানো হতে চলেছে।

বিচারপতি বোবদে: রাজ্যপালকে আমরা আদালতে ডেকে পাঠাতে পারি না, তাঁর কাজে স্থগিতাদেশ দিতে পারি না। যদি রাজ্যপাল ওয়ান-ম্যান পার্টিকে মুখ্যমন্ত্রী করেন, তা হলেও শপথগ্রহণে বাধা দিতে পারি না। তাঁর সরকারকে কাজ করা থেকে নিরস্ত করতে পারি।
আদালতের নির্দেশ শুনিয়ে বিচারপতি সিক্রি: বি এস ইয়েদুরাপ্পা সরকার গঠনের দাবি জানিয়ে রাজ্যপালকে যে চিঠি লিখেছেন, তা আ্যাটর্নি জেনারেলকে আদালতে পেশ করতে হবে। আমরা শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে স্থগিতাদেশ জারি করছি না। কিন্তু পরবর্তী শুনানির আগে তিনি শপথ নিলেও তার ভবিতব্য আদালতের পরবর্তী নির্দেশ বা চৃড়ান্ত রায়ের উপর নির্ভর করবে। শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টায় ফের শুনানি।

সুপ্রিম কোর্টের দিকেই এখন তাকিয়ে কংগ্রেস ও জেডি (এস)। আজ রাহুল গাঁধী দীর্ঘ ক্ষণ কথা বলেন দেবগৌড়ার সঙ্গে। রাহুল মোটেই রণে ভঙ্গ দিচ্ছেন না। কারণ, তাঁর অঙ্ক স্পষ্ট। বিজেপির বিধায়ক ১০৪ জন। আর কংগ্রেস-জেডি (এস)-র ১১৭ জন। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠতা জোগাড় করতে গেলে ইয়েদুরাপ্পাকে কংগ্রেস ও জেডি(এস)-এ ভাঙ্গন ধরাতে হবে। সে কারণে নিজের দলের বিধায়কদের একজোট রাখাটাই এখন রাহুল ও কুমারস্বামীর সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ।

যদিও ইয়েদুরাপ্পা আজ আত্মবিশ্বাস দেখিয়ে বলেন, তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণের ভোটে জিতবেনই। আর তার জন্য ১৫ দিন অপেক্ষারও প্রয়োজন নেই। কিন্তু কী ভাবে জিতবেন, সেই অঙ্ক জানাননি। কংগ্রেস ধরে নিয়েছে, আনন্দ সিংহ ও প্রতাপ গৌড়া পাটিলসহ তাদের অন্তত তিন বিধায়ক বিজেপিতে যাবেন। বিজেপির প্রকাশ জাভড়েকর অভিযোগ করেন, কংগ্রেস তাঁদের একাধিক বিধায়কের সই জাল করেছে! এই অবস্থায় কংগ্রেস ও কুমারস্বামী অভিযোগ করেন, তাঁদের ইডি, সিবিআইয়ের ভয় দেখানো হচ্ছে। এই অবস্থায় অনেকেই আগামিকাল সুপ্রিম কোর্টের গতিবিধিটা দেখে নিতে চান।

অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের মনোনয়ন করে ইয়েদুরাপ্পা যাতে নতুন চাল দিতে না পারেন, তার জন্য আজ ফের সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছে কংগ্রেস। দলের নেতা রণদীপ সুরজেওয়ালা আজ বলেন, ‘‘বজুভাই বালা এক সময় গুজরাতে নরেন্দ্র মোদীর জন্য নিজের আসন ত্যাগ করেছিলেন। এ বার মোদীর জন্য সংবিধানকে ত্যাগ করলেন রাজ্যপাল হিসেবে। অমিত শাহকে চ্যালেঞ্জ, সাহস থাকলে এক দিনের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ করুন।’’ কংগ্রেসের এক নেতার মতে, সুপ্রিম কোর্ট ইয়েদুরাপ্পাকে সরালে ভাল। দু’দিনের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ করতে বললেও ক্ষতি নেই কংগ্রেসের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন