সংসদ অচল করে রাখার রাজনীতি সুদে-আসলে বিজেপিকে ফিরিয়ে দিতে চায় কংগ্রেস। সংসদের বাজেট অধিবেশনে দলের রণনীতি কী হবে তা ঠিক করতে আজ বৈঠক করলেন সনিয়া গাঁধী। বৈঠকে ছিলেন এ কে অ্যান্টনি, গুলাম নবি আজাদ, মল্লিকার্জুন খড়্গে, জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া ও আনন্দ শর্মা। বৈঠকের পরে কংগ্রেসের নেতারা বুঝিয়ে দিয়েছেন, শুধু রেল ও সাধারণ বাজেট পাশ করাতে সাহায্য করবেন তাঁরা। কিন্তু মোদী সরকার গত দু’মাসে যে আটটি অর্ডিন্যান্স জারি করেছে, আসন্ন অধিবেশনে তার একটিও পাশ করাতে দিতে রাজি নয় কংগ্রেস। এর মধ্যে রয়েছে বিমা বিলে বিদেশি লগ্নির সীমা বাড়ানো, কয়লা খনি বণ্টন, জমি বিল সংশোধনের মতো অর্ডিন্যান্স। এগুলির ভবিষ্যৎ নিয়ে তাই প্রশ্ন উঠে গেল অধিবেশন শুরুর আগেই।
কারণ রাজ্যসভায় গরিষ্ঠতা নেই সরকারের। সেখানে বিল খারিজ হলে যৌথ অধিবেশন ডেকে তা পাশ করানো যায়। দরকারে তা করার কথা এ বারেও বলছে বিজেপি। কিন্তু অধিবেশনই যদি না চলে, তবে বিল নিয়ে ভোটাভুটি বা তা খারিজ হওয়ারই সুযোগ থাকবে না। সে ক্ষেত্রে যৌথ অধিবেশনেও তোলা যাবে না ওই সব বিল। কংগ্রেস তাই সংসদ অচল করে রাখাটাই সরকারকে চাপে ফেলার মোক্ষম অস্ত্র বলে মনে করছে।
রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় একাধিক বারই সংসদ অচল রাখার রাজনীতির সমালোচনা করেছেন। পরের পর অর্ডিন্যান্স জারি করা নিয়ে সরকারকে যেমন সতর্ক করেছেন, তেমনই সূত্রের খবর, কংগ্রেস সভানেত্রীকেও তিনি সংসদ অচল করে রাখার কুফল সম্পর্কে কংগ্রেসের অতীত অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কে কার কথা শোনে! ইউপিএ জমানায় দশ বছর বিবিধ বিষয়ে সংসদ অচল করে রেখেছিল বিজেপি। রাষ্ট্রপতির হুঁশিয়ারি উপেক্ষা করে, এ বারও বিজেপির দেখানো পথেই হাঁটতে চাইছে কংগ্রেসা।
আটঘাট বাঁধছে বিজেপিও। বিরোধী শিবিরে ভাঙন ধরাতে তৎপর খোদ প্রধানমন্ত্রী। গত পরশু সনিয়ার রাজনৈতিক সচিব আহমেদ পটেলের সঙ্গে সংসদ চালু রাখা নিয়ে এক দফা কথা বলেছেন সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী বেঙ্কাইয়া নায়ডু। তবে আহমেদ গত কালই বলেছেন, “গরিবদের কল্যাণের জন্য বিগত ইউপিএ সরকারের নীতি ও কর্মসূচি লঘু করে কংগ্রেসের থেকে কী ভাবে সমর্থন আশা করে বিজেপি?”
সরকার-কংগ্রেস সংঘাতের মূল বিষয় হতে চলেছে ইউপিএ জমানার জমি অধিগ্রহণ আইন। সরকার ওই আইন পাল্টে কৃষক-স্বার্থ লঘু করেছে বলে মনে করে কংগ্রেস। এর প্রতিবাদে অণ্ণা হজারে জমি-প্রশ্নে ময়দানে নামার ঠিক আগের দিন, ২৫ তারিখ কংগ্রেস রাহুল গাঁধীর নেতৃত্বে ধর্না দেবে যন্তর-মন্তরে। দল সরব হবে সংসদেও। বিজেপি অবশ্য বলছে, কংগ্রেস জমি আইন সংশোধন নিয়ে খামোখা প্রশ্ন তুলছে। ইউপিএ জমানার জমি আইনে এক ছটাক জমিও অধিগ্রহণ করা যেত না। সরকার কিছু ক্ষেত্রে কৃষক তথা গ্রামসভার সম্মতি নেওয়ার শর্ত বিলোপ করেছে। এতে কৃষকদের একটুও ক্ষতি হবে না।
সংসদে সরকারকে চেপে ধরতে নতুন কিছু অস্ত্রও পেয়েছে কংগ্রেস। প্রধানমন্ত্রীর স্যুট নিলাম থেকে শুরু করে আরব সাগরে নৌকো উড়িয়ে দেওয়ার দাবি ঘিরে বিতর্ক ও বাজেটের মুখে পেট্রেলিয়াম মন্ত্রকে চরবৃত্তির মতো প্রসঙ্গ সেগুলির কয়েকটি। তবে কংগ্রেসের পাখির চোখ জমি আইন। কৃষক-স্বার্থে আঘাত করার মতো বিষয় থেকে নজর ঘোরাতেই গত ক’দিন ধরে অন্য সব বিষয় সামনে আনা হচ্ছে কি না, সেই সন্দেহও তৈরি হয়েছে কংগ্রেসে। আরব সাগরে নৌকো বিস্ফোরণের ভিডিও প্রকাশের পিছনেও একই কৌশল রয়েছে কি না, তা নিয়েও ধন্দে রয়েছে কংগ্রেস।
তবে প্রশ্ন হল, সমালোচনার মুখে পড়ার আশঙ্কা নিয়েও কংগ্রেস কেন সংসদ অচল করে রাখতে এতটা তেড়েফুঁড়ে নামতে চাইছে? দলের নেতারা মানছেন, এটা খোয়ানো জমি ফিরে পাওয়ার চেষ্টা। বিশেষ করে, জমি প্রশ্নে সরব হয়ে অণ্ণা হজারে যখন ফের কংগ্রেসের পরিসরে থাবা বসানোর জন্য তৎপর হয়ে উঠেছেন। তা ছাড়া, দিল্লির ভোটে কংগ্রেস সাফ হয়ে গেলেও ওই নির্বাচনে ধাক্কা খেয়েছে বিজেপিও। এতে মনোবল বেড়েছে কংগ্রেসের। মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ়, রাজস্থানের মতো বিজেপি-শাসিত রাজ্যে কংগ্রেস এখন আগের থেকে অনেক বেশি আক্রমণাত্মক।
সংসদে বিজেপিকে বেকায়দায় ফেলতে আনন্দ শর্মা, গুলাম নবি আজাদরা এখন আশা নিয়ে তাকিয়ে রয়েছে তৃণমূল, সংযুক্ত জনতা দল, সমাজবাদী পার্টির দিকেও। বিশেষ করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং নীতীশ কুমার এখন বিজেপির উপরে বেজায় চটে রয়েছেন। সংসদের অধিবেশন তাঁরাও মসৃণ হতে দিতে চান না। সূত্রের খবর, এই ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ দলগুলির সঙ্গে তলে তলে যোগাযোগ রাখছে কংগ্রেস।
শুধু বিরোধীরা নয়, ঘরশত্রুরাও উদ্বেগে রেখেছেন মোদী, অরুণ জেটলিদের। সাক্ষী মহারাজ, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নিরঞ্জন জ্যোতি, যোগী আদিত্যনাথদের মতো বিজেপির নেতা-নেত্রীর সাম্প্রদায়িক মন্তব্যের জেরে শীতকালীন অধিবেশন অনেকটাই পণ্ড হয়েছে। এ বার অন্তত দলের এই অংশ মুখে কুলুপ এঁটে না রাখলে ফের বিড়ম্বনায় পড়তে হবে। এ ব্যাপারে সঙ্ঘ পরিবারের সাহায্যও চাইছেন মোদী-জেটলিরা। তাঁদের চিন্তা রয়েছে বাজেট নিয়েও। মোদী সরকারের প্রথম পূর্ণাঙ্গ বাজেটে আর্থিক সংস্কার নিয়ে বিপুল প্রত্যশা রয়েছে শিল্পপতি ও বণিক মহলের। আবার মানুষও চাইছেন কর ও জিনিসপত্রের দামে সুরাহা। ভারসাম্য রাখতে না পারলে তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে। সব মিলিয়ে বাজেট অধিবেশনের আগে এখন থেকেই চাপে রয়েছে সরকার।