বিহার আছে বিহারেই। উন্নয়ন নয়, এই রাজ্যের রাজনীতি যে জাতপাত ও সম্প্রদায়-ভিত্তিক কুশলী সমীকরণের মধ্যেই ঘোরাফেরা করে, আগামী ১৬ মে তা আরও এক বার প্রমাণ হতে চলেছে বলে মনে করছেন রাজ্য রাজনীতির পর্যবেক্ষকেরা।
বিহারে এ বারের লোকসভা ভোটে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ তাঁরা লক্ষ করেছেন। প্রথমত, রাজ্যের ভোটারদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ চূড়ান্ত করেছে মোদী-হাওয়া। দ্বিতীয়ত, সেই মোদী-হাওয়ার জেরে এবং নিজস্ব রাজনৈতিক বিচক্ষণতায় কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধে রাজ্যের মুসলিমদের পূর্ণ সমর্থন পেয়ে পাদপ্রদীপের আলোয় ফিরে এসেছেন প্রায় অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাওয়া লালু প্রসাদ। এবং তৃতীয়ত, মাত্রাতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের (কেউ কেউ যাকে ‘উন্নাসিকতা’ এবং ‘ঔদ্ধত্য’ বলতেও ছাড়ছেন না) খেসারত দিয়ে অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়ে গিয়েছেন আজকের বিহারের রূপকার নীতীশ কুমার। তা এতটাই যে, অদূর ভবিষ্যতে তাঁর মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সি থাকবে কি না, সেই প্রশ্নও তুলে দিয়েছে ২০১৪-র সাধারণ নির্বাচন।
প্রাক্-নির্বাচনী সমীক্ষায় বিহারে মোদী-ঝড়ের ইঙ্গিত মিলেছিল। বুথ-ফেরত সমীক্ষাতেও একই পূর্বাভাস। তাতে বলা হচ্ছে, বিহারের ৪০টি লোকসভা আসনের মধ্যে ২০-২১টি পেতে পারে বিজেপি জোট। কংগ্রেস-আরজেডি জোট ১৪ থেকে ১৫টি আসন পেতে পারে। আর নীতীশের জেডিইউয়ের কপালে বরাদ্দ হতে পারে বড়জোর ৪ থেকে ৫টি আসন।
নরেন্দ্র মোদীকে বিজেপি প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী ঘোষণা করার পর এনডিএ ছাড়েন নীতীশ। ১৭ বছরের পুরনো জোট ভাঙার সময়ে তাঁর একটা নিজস্ব হিসেব অবশ্যই ছিল। দলে নীতীশের ঘনিষ্ঠ এক নেতার কথায়, “মহারাজগঞ্জ লোকসভা উপ-নির্বাচনে জিতেছিল আরজেডি। কিন্তু ওই লোকসভা কেন্দ্রের ৬০টি মুসলিম প্রধান গ্রামে জেডিইউ প্রার্থী গড়ে ৪৫ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন।” নীতীশ বিজেপির সঙ্গ ছাড়েন এই তথ্য হাতে পাওয়ার ১৫ দিনের মাথায়। তাঁর অঙ্কটা ছিল এই রকম অতি পিছড়ে বর্গের (মোস্ট ব্যাকওয়ার্ড ক্লাস বা ‘এমবিসি’) ২১ শতাংশ ভোট ও ১০ শতাংশ মহাদলিত ভোট তিনি পাবেন। সঙ্গে রাজ্যের প্রায় ১৫% মুসলিম ভোটের সিংহভাগও সঙ্গে থাকলে ইভিএমে বাজিমাত করতে সমস্যা হবে না বলে ভেবেছিলেন নীতীশ। সর্বোপরি নিজের উন্নয়ন তাসের উপরে আস্থা ছিল মুখ্যমন্ত্রীর।
কিন্তু ভোট যত এগিয়েছে, পরিস্থিতি বদলেছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, স্রেফ নিজের অহং থেকে মোদী-হাওয়াকে স্বীকার করতে চাননি নীতীশ। সেটা বুঝলে মুসলিম ভোট এককাট্টা করতে তিনি নিজেই কংগ্রেসের সঙ্গে জোট গড়তে উদ্যোগী হতেন। তা করেননি সেই অহংয়ের কারণেই। আসলে লালুকে তিনি ধর্তব্যের মধ্যেই আনেননি।
লালু যখন পশুখাদ্য মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়ে জেলে গেলেন, তখন নীতীশের মতো অনেকেই ভেবেছিলেন, তাঁর রাজনৈতিক জীবনে দাঁড়ি পড়ে গেল। এই কথাটি লালুও মাঝে-মধ্যে বিভিন্ন জনসভায় উল্লেখ করেছেন, “সব সোচ রহা থা, ব্যস, লালু গয়া।” বাস্তবে দেখা গেল, দুর্নীতির দায়ে দোষী সাব্যস্ত হওয়া লালু নিজেকে আদ্যন্ত ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে তুলে ধরলেন। প্রবল মোদী হওয়ার মুখে দাঁড়িয়েও তিনি উস্কে দিলেন ’৯০-এর স্মৃতি কী ভাবে থামিয়েছিলেন আডবাণীর রামরথের গতি, সেই কাহিনি সভায় সভায় বলে বেড়ালেন। মোদীকে ঠেকাতে অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে কার্যত কংগ্রেসের শর্তেই বিহারে জোট গড়লেন। বিহারে মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপির একমাত্র বিকল্প হিসেবে এই জোটই মুসলিমদের আস্থা অর্জন করল।
তৃপ্ত লালু এখন বলছেন, “রাজ্যের ৪০টি আসনেই যাদব এবং মুসলিম ভোট আমাদের অনুকূলে। এমনটা আমিও ভাবিনি।” বিজেপির এক প্রথম সারির নেতা মেনেই নিচ্ছেন, যাদবরা লালুকে ছেড়ে যাবে না। লালু এখনও তাদের ‘হিরো’। তিনি সংখ্যালঘুদেরও আস্থা অর্জন করায় রাজ্যে ভোটের ৩০% নিশ্চিত ভাবে কংগ্রেস-আরজেডি জোটের পক্ষে গিয়েছে বলে ওই নেতার মত। এবং তিনি সাফ বলছেন, “রাজ্য-রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিকতা ফিরে পাচ্ছেন লালু প্রসাদ। সেই কারণেই রাজ্যের অধিকাংশ আসনে লড়াইটাই হয়েছে বিজেপি বনাম কংগ্রেস-আরজেডি জোট।”
অন্য দিকে নীতীশ স্রেফ একগুঁয়েমি ও ভুল রাজনীতির কারণে প্রাসঙ্গিকতা হারাতে বসেছেন। অনেকে খোলাখুলি বলছেন, নিজের অহংয়ের দোষেই শিবানন্দ তিওয়ারি, এল কে সিংহের মতো নেতাদের হারিয়েছেন নীতীশ। যাঁরা ভুল ধরিয়ে দিতে গিয়েছেন, তাঁরা রোষের বলি হয়েছেন। আসলে জোটের ফলের সঙ্গে একক ফলের ফারাকটা যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিশাল, নীতীশ সেটাই বুঝতে পারেননি। বিজেপির সঙ্গ ছাড়াটাই তাঁর কাল হল। বোধহয় নিজেও সেটা বুঝেছেন বলেই বিভিন্ন প্রচার সভায় নীতীশকে বলতে শোনা গিয়েছে, “নীতির জন্য নিজেকে বলি দিয়েছি। আর কোনও দিন বিজেপির হাত ধরব না। তাতে যদি মাটির সঙ্গেও মিশে যাই, তাতে আমার কোনও আফসোস থাকবে না।” প্রচার সভাগুলিতে হাতিয়ার করতে চেয়েছিলেন উন্নয়নকেই। কিন্তু উন্নয়ন নয়, শেষ পর্যন্ত মোদী-হাওয়া ও তার প্রেক্ষিতে বিহারের রাজনৈতিক-সামাজিক মেরুকরণেই কোণঠাসা মুখ্যমন্ত্রী। এমনকী দিল্লিতে বিজেপি ক্ষমতায় এলে তাঁর সরকার যে বিপদের মুখে পড়বে, সে আশঙ্কাও নীতীশ ব্যক্ত করছেন ঘনিষ্ঠ মহলে। এমনিতেই তাঁর সংখ্যালঘু সরকার চলছে কংগ্রেসের সমর্থনে। দিল্লিতে মোদী ক্ষমতায় এলে উজ্জীবিত বিহার বিজেপি যে বসে থাকবে না, সেটাও বুঝেছেন নীতীশ।
জেডিইউয়ের ঘরে-বাইরে এখন প্রশ্ন ফল প্রকাশের পরে যদি দেখা যায় মানুষের সমর্থন হারিয়েছেন নীতীশ, তাঁর সরকারের ভবিষ্যত্ কী? সে ক্ষেত্রে মেয়াদ ফুরনোর আগেই কি ইস্তফা দিতে পারেন মুখ্যমন্ত্রী? জেডিইউ সূত্রের খবর, দলীয় বিধায়কদের একাংশ নাকি দল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিতে তৈরি।
আধুনিক বিহারের রূপকার নীতীশ আজ সত্যিই নিঃসঙ্গ।