বাবার জন্মদিন আসছে সামনেই। বাবা না বলে বরং পিতৃদেব বলাই এ ক্ষেত্রে শ্রেয়। না। শুধু আমারই নন। আপনার আমার সকলের। মুন্নাভাই তথা সারকিটের। এ দেশের মহান জাতির জনক মোহনদাস করমচাঁদ গাঁধির। তা, এই মহামানবের হ্যাপি বার্থডে-তে কী হবে? দিকে দিগন্তে সবাই উৎসবে মেতে ওঠে তার জয়গান গেয়ে আকাশ-বাতাস কাঁপাবে? সে গুড়ে বালি। জনগণমনের সমবেত আনন্দ বা খুশি হবার প্রধান কারণ একটিই। গুপী গায়েন বাঘা বায়েনের শুণ্ডি রাজার কায়দায় বলা যায় ছুটি-ছুটি-ছুটি! ফলে শুককুরে ছুটি পাওয়াতে শনিবারটা সিক বা ক্যাজুয়াল মেরে দিলেই দিঘা, ফ্রেজারগঞ্জ, ঘাটশিলা কিংবা গোয়া, ম্যাথেরান বা ‘আতি কেয়া খান্ডালা’ জমে যায়! অপর পক্ষে রসভঙ্গ হয় রসিকজনের। আহা, গোটা দেশজুড়ে যে সোমরসের, দোকানপাটে বাধ্যতামূলক ‘ড্রাই ডে’!
তবে হ্যাঁ, বলতে গেলে গাঁধিবাদী বা মুন্নাভাইয়ের ভাষায় খ্যাত ‘গাঁধিগিরি’র মানুষজনের তৎপরতা সে দিন খানিকটা বেড়ে যায়। ভারতের বিভিন্ন শহর-গ্রামগঞ্জের খামচা-খামচা পল্লি বা পকেটগুলিতে। এক দিন আগে থেকেই শিকেয় তুলে রাখা অথবা মাকড়সার জালে জর্জরিত ছবি-ফোটো-স্ট্যাচুদের খোঁজ পড়ে। ছবির কাচ ফাটা থাকলে—নতুন কাচ লাগানো হয়। ঝাড়া-পোঁছা হয় অতি যত্ন সহকারে।
এমনিই গুটিকয়েক দিন সরকারি নির্দেশ পালনে বা ক্লাব-পাড়ায় নাম কে ওয়াস্তে ভারতীয় মনীষী-মুনি-ঋষি তথা নেতাদের খোঁজখবর কেউই নেয় না। ভাবখানা—
‘‘আরে, সেই মেলা থেকে মূর্তিটা কিনলুম —অত্ত দাম দিয়ে— গেল কোথায়?’’
‘‘জানি না তো—’’
‘‘আরে খোঁজ-খোঁজ এই শুককুরে মানুষটার জন্মদিন না? একটা মালা-ফালা কিনে, গলায় ঝোলাতে হবে। পয়সা দিয়ে কেনা বাবা—ফোকোটে তা আসেনি—’’ এর থেকে অপমান আর কী হতে পারে কোনও মহাপুরুষের— মুখুজ্জের অন্তত জানা নেই।
হে সহৃদয় পড়ুয়া! এই যে আপনি অনুগ্রহ করে মুখুজ্জের মনতাজ পড়ছেন। হরফগুলি কাগের ঠ্যাং-বগের ঠ্যাং মনে হচ্ছে না—এদের স্রষ্টার কথা কী মনে পড়ছে? খটমটো সংস্কৃতির সুবিশাল জ্ঞান-জঙ্গল থেকে খুঁজে খুঁজে আহরণ করে যিনি বর্ণ সমূহের সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন সেই প্রায় বিস্মৃত শৈশবে হাতেখড়ির পর তাঁর প্রথম বইটি মনে করুন। বর্ণ পরিচয়! সহজ পাঠ? মনে পড়ে! সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (তৎকালীন কলকাতার বিদ্বান সমাজ তাঁকে এই বিখ্যাত উপাধি বা অহংকারে ভূষিত করেছিলেন।) কবে জন্মগ্রহণ করেছিলেন চট করে কী মনে পড়বে? না। অধমেরও পড়েনি। কারণ, আমরা বাঙালিরা ছাড়া এই পশ্চিমের শহরে বা রাজ্যে তাঁর নাম শতকরা দু’জনও জানেন কিনা আমার সন্দেহ। আপনার আমার কারওরই মনে থাকুক না থাকুক বিদ্যাসাগরের জন্মদিন এই সামনের বুধবার। অধমের বাল্যজীবনের স্কুল সংস্কৃত-কলেজিয়েটের ছ’ধাপ সিঁড়ি বেয়ে উঠলে চারটি মস্ত স্তম্ভের পরেই চত্বরে রয়েছে তাঁর শ্বেতপাথরের আবক্ষ মূর্তি। এক সময়ে মনে পড়ে আমরা তাঁক কণ্ঠে ফুলের মালা দিতুম সব্বাই। মাস্টারমশাই ও ছাত্ররা। বন্দনা করতুম,
‘‘ওঁ সহনা ভবতু, সহনৌভূনক্তু সহবীর্য্যং—করবাবটহ’’
এ কালের ছাত্রছাত্রী বা বইপাড়ার মানুষেরা আজও তেমনই আগের মতোন বিদ্যাসাগরের জন্মদিনে তাঁকে শ্রদ্ধা জানায় কিনা কে জানে’ কোথাও ছুটিছাটা ঘোষণা করেন কী কর্তৃপক্ষ? মনে হয় না। আসলে তাঁর দু’দিন পরেই মহাত্মজির জন্মদিন—সেটি মনে থাকারও একটি বিশেষ কারণ ওই ক্যালেন্ডারে লাল দাগ ওয়ালা ছুটি।
আরও একজনের জন্মদিন পড়ছে এই পক্ষে।
ধর্মপ্রাণা রানি রাসমণির। কতিপয় ধার্মিক বঙ্গসন্তান ছাড়া তাঁর কথা অবিশ্যি কেউই জানেন কিনা সন্দেহ। ফোটো বা মূর্তির কথা ভাবাও অবান্তর। তবে, পঞ্জিকায় পাওয়া যায়।
এ বারে আসুন, মনের তাজমহলে মূর্তিপ্রসঙ্গ হাতড়ানো যাক।
প্রথমেই একটা বিষয়ে আলোকপাত করে রাখা ভাল। এখানে, আমরা গোটা ভারতের মানচিত্র খুলে বসছি না। এমনকী, এই রাজ্য অর্থাৎ, মহারাষ্ট্রের হিসেবনিকেশেও যাবার মতোন বুকের পাটা বঙ্গজাত সন্তানের নেই। সুতরাং আমরা স্রেফ এই শহর মুম্বইয়ের খাতা খুলে হিসেব করব। মূর্তি বা স্ট্যাচুর সংখ্যা যা পাওয়া গেল তাতে মুখুজ্জের অন্তত চক্ষু চড়কগাছ। বারো হাজারেরও বেশি। আজ্ঞে হ্যাঁ। ১২০০০!! স্রেফ একটি শহরে। একের পর এক লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে দিলে দু’চারটে ভুখা-মিছিল ছড়িয়ে যাবে। ‘ভুখা’ মিছিল মনে এল তারও কারণ আছে। জীবদ্দশায় এঁনারা সকলেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই কর্তাব্যক্তি, নেতা, অভিনেতা—মোটা কথা, কেউকেটা ছিলেন। সাধারণ নিয়মে তাবৎ কেউকেটাগণই আপনার তথা জনসাধারণের অ্যাসেটনশান প্রার্থনা করেন। মনোযোগ আকর্ষণের প্রত্যাশা করেন স্বভাবতই। কল্পনা করুন, রাম-শ্যাম-যদু-মধু বা ‘দিন-আনি-দিন-খাই’তে ব্যস্ত কোনও হরিপদ কেরানির শুধু একটু মনোযোগ প্রার্থনা করে বারো হাজার কেউকেটা সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছেন। কী অপরিসীম লজ্জা! কারো–না-কারো কাছে, হয়তো লক্ষ মানুষের চোখে এঁরা প্রত্যেকেই যথেষ্ট শ্রদ্ধেয় ছিলেন—কিন্তু আজ?
তবুও, থামতে চান না বা ‘জানেন না, আমাদের কর্তা বা নেতারা। যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ। এখানে রাবণ হবে না। হবে নেতা। তা সে কোনও দলের হোক বা নির্দলীয়। সরকার বা বিরোধী। মোটকথা, মন্ত্রী না হলেও এম এল এ বা এমপি হলেই হল। অথবা এনাদের হাতা-চামচ-খুন্তি-আমলাও তাঁর দাবি নিয়ে জোরদার আন্দোলনে নেমে পড়লেই হল। ওপর মহলে টনক নড়লেই হয়তো দেখবেন আমার বাসার গলির মোড়ে একটি আট ফুট উঁচু খাম্বা খাড়া হয়ে গেল। আপনারই পাড়ার এক জনের চাঁদবদন বসে গেল তার ওপরে। আপনি জম্মে হয়তো তার নাম শোনেনি—চাক্ষুষ কখনও দেখেছেন কিনা তাও সন্দেহ। তার পর কয়েকটি বছর সম্ভবত ঘটা করে ‘মাল্যদান’-ফান হবে জন্মদিনে। বাকি তিনশো চৌষট্টি দিন খেয়াল রাখবে নভশ্চরগণ। নিত্য এবং প্রত্যহ নিয়ম করে প্রাতঃকৃত্য সেরে যাবেন পক্ষিকুল। বিশেষ করে কাক-কবুতরের দল আপন আপন কায়দায় মাথায় তথা কাঁধে বসে ‘মাল্যদান’ চালিয়ে যাবে নির্বিবাদে। মহাত্মা গাঁধি, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বা মহারাজ শিবাজি। নেহেরু, ইন্দিরা বা তৎপুত্র রাজীব গাঁধী সবাই সমান। ভেদাভেদ, বাছবিচারের বালাই নেই। সবার মস্তকই উপযুক্ত, সব স্কন্ধ বা উত্তলিত বাহুই এক। সকলই টয়লেট!!
মনতাজে মূর্তি বা স্ট্যাচু প্রসঙ্গ মনে পড়বার কারণ একটাই। হাল আমলে কোলাবা অঞ্চলের পুরকর্তা বিনোদ শেখরমশাইয়ের একটি প্রস্তাব শুনে যথেষ্ট চমকিত হয়েছিলুম। কী প্রস্তাব? না মুম্বই শহরের খোদ কাছারি-পাড়ায় একটি স্ট্যাচু লাগানো হোক। বেশ তো! ভাল কথা! কিন্তু স্ট্যাচুটি কার শুনে অবাক না হলে উপায় নেই। রামায়ণ রচয়িতা মহর্ষি বাল্মিকীর! আপিস কাছারি, শেয়ার বাজার, আদালত ইত্যাদির গিসগিসে সদাব্যস্ত ভিড়ের সঙ্গে বাল্মিকীর যোগাযোগ কতটুকু, বোধগম্য হল না। বরং তাঁর আগেকার নাম ও জীবনযাপনের সঙ্গে হয়তো খানিকটা মিল এ ক্ষেত্রে কল্পনা করা যেতেও পারে। প্রকাশ্য দিবালোকে তথা আধো-অন্ধকারে সাদামাঠা মানুষের মুখোশের আড়ালে অসংখ্য দস্যু রত্নাকর ঘুরে বেড়ায়। ঝোঁপ বুঝে কোপ মারবার ধান্ধায়! তবু বাল্মিকীর বরাত ভাল—এ যাত্রা রক্ষে পেয়ে গেছেন। পৌরপিতা ফাটকজি সরাসরি প্রস্তাবটি নাকচ করাতে ঋষিমশাই কাক-কবুতরের ‘মাল্যদানে’র হ্যাপা থেকে রেহাই পেয়েছেন।
মুখুজ্জের মনের তাজমহলে দুটি প্রশ্ন ঘুরে বেড়ায়। এক এ শহরে বারো হাজার গণ্যমান্য, প্রণম্য, বিদগ্ধ নেতা, মণীষী মহাপুরুষরা রয়েছেন অথচ, গত চার দশক ধরে এখানকার মাটি কামড়ে থাকলেও, তাঁদের নামগন্ধও কেন জানা নেই! হায়, বঙ্গসন্তান, ধিক! শত ধিক। জানা আছে স্রেফ তিন জনের নাম। শিবাজি, ছত্রপতি শিবাজি, শিবাজি মহারাজ! প্রচুর মাথা ঘামালে অবিশ্যি আরও দুজন পাওয়া যায়—বাবাসাহেব অম্বেডকর ও বাল গঙ্গাধর তিলক!
পরিশিষ্ট হিসেবে নাট্যজগতের সুপরিচিতা নারী মহাবানু মোদী কোতোয়ালের মহার্ঘ মতের সঙ্গে একমত হয়ে মুখুজ্জে ভাবে—
এই ১২০০০ মূর্তিকে একত্র করে একটা বড়সড় বাগানে রাখা হলে কেমন হয়? মালি গোছের কেউ পরিচর্যা করুন, সিকিউরিটির লোকও থাকুন। এবং সম্প্রতি শেষ হওয়া গণেশের মূর্তির মতোই ওই সব স্টাচুদের জলাঞ্জলি দেওয়া হোক সাড়ম্বরে। আপনিই বলুন, মানুষের কোনও মূর্তিই কী আর গণেশ ঠাকুরের থেকে শ্রেষ্ঠ হতে পারে?