আটক দশ কিশোর উদ্ধার, শুরু পারস্পরিক দোষারোপ

কয়েক মিটার চওড়া কংক্রিটের চাতাল। চারদিক থেকে তীব্র বেগে বয়ে চলেছে জলের স্রোত। কখনও জলের স্রোত ধাক্কা মারছে ওদের কোমরে, হাঁটুতে। কোনও ভাবে দেহের ভারসাম্য বজায় রেখে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে কিংবা বসে থাকা। জলের স্রোতে যাতে ওরা ভেসে না যায় তার জন্য প্রায় আট-ন’ ঘণ্টা এ ভাবেই ওরা দশ জন একে অন্যকে শক্ত করে ধরে রইল।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

রাঁচি শেষ আপডেট: ২২ জুন ২০১৪ ০২:২০
Share:

তখনও বন্দি। ঝাড়খণ্ডের চন্দুয়াডিহির কাছে দামোদরে। চন্দন পালের তোলা ছবি।

কয়েক মিটার চওড়া কংক্রিটের চাতাল। চারদিক থেকে তীব্র বেগে বয়ে চলেছে জলের স্রোত। কখনও জলের স্রোত ধাক্কা মারছে ওদের কোমরে, হাঁটুতে। কোনও ভাবে দেহের ভারসাম্য বজায় রেখে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে কিংবা বসে থাকা। জলের স্রোতে যাতে ওরা ভেসে না যায় তার জন্য প্রায় আট-ন’ ঘণ্টা এ ভাবেই ওরা দশ জন একে অন্যকে শক্ত করে ধরে রইল। বিকেলে জলস্রোতের মাঝে আটকে পড়ে শেষ পর্যন্ত মাঝ রাতে উদ্ধার হল বোকারোর চন্দুয়াডিহির কিশোররা।

Advertisement

পরশু থেকে বোকারোয় ব্যপক বৃষ্টি হচ্ছে। তা সত্ত্বেও দামোদরের জলস্তর তখনও স্বাভাবিক সীমাতেই ছিল। তাই দুগধা বিসিসিএল কলোনির বাসিন্দা সন্তোষ, হরিন্দর, উত্তম, রাজেশ, গুড্ডু, পরমানন্দরা গিয়েছিল দামোদরে মাছ ধরতে। তেনুঘাট জলাধারে অবশ্য জলস্তর ততক্ষণে বিপদ সীমার ওপরে উঠে গিয়েছে। ফলে সেখান থেকে জল ছাড়া হয়। ষোল থেকে আঠারো বছরের সব মিলিয়ে বারো জন কিশোর তখন দামোদরে। তাদের মধ্যে দু’জন জল বাড়তে দেখে সাঁতার কেটে নদীর ধারে চলে আসে। কিন্তু অন্যরা আটকে পড়ে জলের মাঝখানে। প্রাণে বাঁচতে তারা কোনও ভাবে পৌঁছে যায় ওই জলাধারের কাছে চন্দ্রপুরা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের একটি পাম্প হাউসের সামনের কংক্রিটের চাতালের কাছে। ওখানে উঠেই আটকে পড়ে তারা।

গত কালই স্থানীয় মানুষ অভিযোগ করেছিলেন জল ছাড়ার আগে সতর্কতা জারি করা হয়নি। আজ তা সত্যি বলেই জানিয়েছেন বোকারোর জেলাশাসক উমাশংকরও। কেন তেনুঘাট থেকে এ ভাবে না বলে জল ছাড়া হল তা জানতে চেয়ে ডেপুটি কমিশনারের দফতর থেকে তেনুঘাট বিদ্যুৎ নিগমের কাছে কৈফিয়ত চাওয়া হয়েছে বলে জেলাশাসক জানান। তিনি বলেন, “পুরো ঘটনার জন্য তেনুঘাট কর্তৃপক্ষই দায়ী। তাঁরা জল ছাড়ার ব্যাপারে আগাম কিছু জানাননি। একই সঙ্গে কী করে তাদের নজর এড়িয়ে ওই ‘ডেনজার জোন’-এ দশ কিশোর চলে গেল তা জানতে চন্দ্রপুরা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাছেও আমরা কৈফিয়ত চেয়েছি।” উল্লেখ্য, ওই কংক্রিট চত্বর ও সংলগ্ন পাম্প হাউস থেকে চন্দ্রপুরায় জল সরবরাহ করা হয়।

Advertisement

তবে তেনুঘাট কর্তৃপক্ষ জেলাশাসকের অভিযোগ মানতে চাননি। তেনুঘাট বাঁধের চিফ ইঞ্জিনিয়ার অরবিন্দ ঝা বলেন, “দশ দিন আগে থেকে কাগজে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হচ্ছে। প্রতি বছরই দেওয়া হয়। এই সময়ই জল ছাড়া হয়। এ বারেও বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানানো হয়েছে ১৬ জুন থেকে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত যেন নদীতে কেউ না যায়। তা ছাড়া জেলাশাসক-সহ জেলার সব স্তরেই বিষয়টি জানানো হয়েছে।” তাঁর কথায়, “আমরা মাত্র তিন হাজার কিউসেক জল ছেড়েছি। যেখানে ঘটনা ঘটেছে সেটা তেনুঘাট থেকে পঞ্চান্ন কিলোমিটার দূরে। ওই পর্যন্ত যেতে যেতেই আমাদের জলের স্তর শূন্য হয়ে যাবে। তার আগে ডিভিসির কোনার বাঁধ এলাকা রয়েছে। সেখানকার জল হয়তো বেশি ছিল। সেখানকার জল ছাড়ার কারণেই এমন ঘটনা ঘটেছে। দোষ দেওয়া হচ্ছে তেনুঘাটকে।”

জলের তোড় বেশি থাকায় গত কাল সন্ধ্যার পরে প্রশাসনের উদ্যোগে স্থানীয় জেলেরা জলে নামলেও ওই কিশোরদের কাছে তারা প্রথমে পৌঁছতে পারেনি। পরে তেনুঘাট থেকে জল ছাড়া বন্ধ করলে রাতের দিকে জলের তোড় কমতে থাকে। শেষ পর্যন্ত রাত পৌনে একটা নাগাদ ওই কিশোরদের জলের বাইরে বার করে নিয়ে আসেন স্থানীয় জেলেরা।

দিন কয়েক আগে মাণ্ডিতে এভাবেই জল ছাড়ার কারণে বিপাশা নদীতে ভেসে যায় হায়দরাবাদের একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের বেশ কয়েক জন ছাত্র। বিসিসিএল কলোনির বাসিন্দারা সে সম্বন্ধে ততটা সচেতন নন।

বাড়ির ছেলেরা বেঁচে ফিরে আসাতেই স্বস্তি তাঁদের। আটক দশজনের একজন, সন্তোষ কুমারের কথায়, “জল বেড়ে যাবে জানলে মাছ ধরতে যেতাম না। জলের তোড়ের শব্দে হাড় হিম হয়ে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, আর মা-বাবার সঙ্গে দেখা হবে না। যখন ধীরে ধীরে জল পায়ের পাতার কাছে নেমে এল, তখন মনে হল ঈশ্বর রক্ষা করেছেন।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন