কেন্দ্রে রদবদল

আস্থা জেটলিতে, নিতিনে অস্বস্তি

প্রধানমন্ত্রী পদে শপথ নেওয়ার আগে বলেছিলেন, তাঁর নীতি হল ‘মিনিমাম গভর্নমেন্ট, ম্যাক্সিমাম গভর্ন্যান্স’। এক-এক জন মন্ত্রীর হাতে দিয়েছিলেন দুই বা ততোধিক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রক। মন্ত্রিসভার প্রথম রদবদলের আগে সেই নীতিতেই কি অবিচল থাকবেন নরেন্দ্র মোদী, নাকি বাস্তব চাহিদা অনুযায়ী নিয়ে আসবেন নতুন মুখ? বর্তমান মন্ত্রীরাও কি সকলেই বহাল থাকবেন স্বপদে? এমন অজস্র প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে সাত রেসকোর্সের আশপাশে।

Advertisement

জয়ন্ত ঘোষাল

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০১ নভেম্বর ২০১৪ ০৩:৩৩
Share:

প্রধানমন্ত্রী পদে শপথ নেওয়ার আগে বলেছিলেন, তাঁর নীতি হল ‘মিনিমাম গভর্নমেন্ট, ম্যাক্সিমাম গভর্ন্যান্স’। এক-এক জন মন্ত্রীর হাতে দিয়েছিলেন দুই বা ততোধিক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রক। মন্ত্রিসভার প্রথম রদবদলের আগে সেই নীতিতেই কি অবিচল থাকবেন নরেন্দ্র মোদী, নাকি বাস্তব চাহিদা অনুযায়ী নিয়ে আসবেন নতুন মুখ? বর্তমান মন্ত্রীরাও কি সকলেই বহাল থাকবেন স্বপদে? এমন অজস্র প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে সাত রেসকোর্সের আশপাশে।

Advertisement

অর্থ ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী অরুণ জেটলি এবং বিজেপি সভাপতি অমিত শাহের সঙ্গে রদবদল নিয়ে একটা প্রাথমিক আলোচনা সেরে রেখেছেন মোদী। নিজের মতামত ব্যক্ত না করলেও সতীর্থদের বক্তব্য শুনেছেন। সঙ্ঘপ্রধান মোহন ভাগবতের সঙ্গেও এ নিয়ে তিনি শীঘ্রই কথা বলবেন বলে ঠিক হয়ে রয়েছে। এখন দেখার, ২৪ নভেম্বর, সংসদের শীতকালীন অধিবেশন শুরুর আগেই রদবদলটা তিনি সেরে ফেলতে পারেন কি না।

জেটলির দায়িত্বভার অবশ্য কমছে না। সম্প্রতি অস্ত্রোপচার হয়েছে তাঁর। থাকতে হচ্ছে নানা বিধিনিষেধের মধ্যে। এই অবস্থায় অরুণ শৌরি বা গোয়ার মুখ্যমন্ত্রী মনোহর পারিক্করকেও প্রতিরক্ষা মন্ত্রকে আনার প্রস্তাব দিয়েছিলেন কেউ কেউ। মন্ত্রিসভা গঠনের সময়ে যেমন শিবসেনা নেতা সুরেশ প্রভুকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক দেওয়ার কথা হয়েছিল। কিন্তু মোদী সম্প্রতি সমস্ত জল্পনার অবসান ঘটিয়ে জেটলিকে বলে দিয়েছেন, অর্থের পাশাপাশি প্রতিরক্ষা মন্ত্রকও তাঁকে সামলাতে হবে।

Advertisement

এর অন্যতম কারণ, অর্থ মন্ত্রকের মতো প্রতিরক্ষা মন্ত্রকেও বেশ কিছু সংস্কার করতে চাইছেন প্রধানমন্ত্রী। সেইমতো প্রতিরক্ষা-সংস্কারের কাজ পুরোদমে শুরু করে দিয়েছেন জেটলি। একটি প্রতিরক্ষা সংস্কার নীতি প্রণয়ন করার কথা হচ্ছে। এই অবস্থায় মাঝপথে জেটলিকে সরিয়ে দিতে মোদী রাজি নন।

তবে জেটলিকে দু’জন শক্তপোক্ত প্রতিমন্ত্রী রাখার পরামর্শ দিয়েছেন মোদী। সেই সূত্রেই প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী যশবন্ত সিন্হার ছেলে, ‘ম্যাকিনসে’- তে কাজ করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন জয়ন্ত সিন্হাকে অর্থ প্রতিমন্ত্রী করার কথা ভাবা হচ্ছে। অর্থ মন্ত্রকের বর্তমান প্রতিমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন। কিন্তু প্রথম বার মন্ত্রী হওয়া নির্মলা বাণিজ্য মন্ত্রকেরও স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত। সেই মন্ত্রকের কাজ অনেক। বাণিজ্যমন্ত্রীকেও প্রচুর বিদেশ সফরেও যেতে হয়। এই কারণে নির্মলাকে অর্থ প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে রেহাই দেওয়া উচিত বলে মনে করছেন জেটলিও।

প্রতিরক্ষা মন্ত্রকেও নতুন প্রতিমন্ত্রী আনার কথা হচ্ছে। বর্তমান প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী রাও ইন্দ্রজিৎ সিংহের কাজে জেটলি মোটেই খুশি নন। তিনি চাইছেন এমন কাউকে, যিনি স্বচ্ছ ভাবমূর্তির তো হবেনই, কাজটাও ভাল বুঝবেন। যিনি প্রয়োজনে সেনাপ্রধানদের সঙ্গে অস্ত্র কেনাবেচা নিয়ে আলোচনা এগিয়ে নিয়ে যাবেন, আবার প্রতিরক্ষা-সংস্কারের নীতি নির্ধারণের কাজেও তাঁকে সাহায্য করতে পারবেন।

সমস্ত আইনি দিক বিবেচনা করে জেটলি এখন এমন একটি প্রতিরক্ষা সংস্কার নীতি তৈরি করতে চাইছেন, যাতে দুর্নীতিকে প্রথমেই রুখে দেওয়া যায়। ইউপিএ জমানায় এ কে অ্যান্টনি যখন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ছিলেন, তখন দুর্নীতির ভয়ে প্রতিরক্ষা বাণিজ্য কার্যত বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু জেটলি মনে করেন, দেশের নিরাপত্তার স্বার্থেই প্রতিরক্ষা বাণিজ্য প্রয়োজন। আর সেই কারণেই অস্ত্র কেনাবেচা সংক্রান্ত কমিটির যে বৈঠক আগে ছ’মাসে এক বার হতো, এখন তা প্রতি মাসে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন জেটলি। প্রতিরক্ষা খাতে বিদেশি বিনিয়োগ ৪৯ শতাংশ হওয়ায় এখন বিদেশি সংস্থাগুলি টেন্ডারে যোগ দিতে পারবে।

খুব স্বাভাবিক কারণেই এই অবস্থায় জেটলিকে ছাড়তে চাইবেন না মোদী। আর জেটলিও বেশ বুঝছেন, মন্ত্রিসভায় তাঁর গুরুত্ব বাড়তে চলেছে।

বরং চাপে রয়েছেন নিতিন গডকড়ী। মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী পদ নিয়ে জলঘোলার সময়ে গডকড়ী বলেছিলেন, তিনি দিল্লিতেই ‘বেশ আছেন’। কিন্তু রাজধানীর অন্দরের খবর তা বলছে না। গডকড়ীর হাতে পরিবহণ (সড়ক ও জাহাজ) মন্ত্রক আগে থেকেই ছিল। গোপীনাথ মুন্ডের মৃত্যুর পরে তাঁর গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকটিও গডকড়ীকে দেওয়া হয়। কিন্তু সম্প্রতি বেশ কয়েকটি মন্ত্রিসভার বৈঠকে গডকড়ী যখন তাঁর আলোচ্যসূচি পেশ করেছেন, তখন অন্তত তিন বার ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী। গডকড়ীকে বলেছেন, তিনি যেন মন্ত্রকের কাগজপত্রে স্পষ্টতা বজায় রাখেন। কারণ, তাঁর বিভিন্ন মন্ত্রকের কর্মসূচি কী কী, সে বিষয়ে গডকড়ী স্পষ্ট দিশা দিতে পারছেন না (আগামী ৫ নভেম্বর পরিকাঠামো উন্নয়ন নিয়ে মন্ত্রিসভার আরও একটি জরুরি বৈঠক ইতিমধ্যেই ডেকে রেখেছেন মোদী)।

সরকারের কাজে গতি আনার কথা মাথায় রেখেই এক ছাতার তলায় পরিকাঠামোকে নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন মোদী (ঠিক যেমন শক্তি, কয়লা এবং অপ্রচলিত শক্তি মন্ত্রকের দায়িত্ব তিনি দিয়েছেন স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী পীযূষ গয়ালের হাতে)। মন্ত্রিসভা গঠনের আগে পরিবহণ সংক্রান্ত সব ক’টি মন্ত্রককে মিশিয়ে দেওয়ার ভাবনার কথাও শোনা গিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রেল ও বিমান মন্ত্রক আলাদাই থেকেছে। এ দিকে, সড়ক পরিবহণ, জাহাজ ও গ্রামোন্নয়নের মতো তিন গুরুভার মন্ত্রক সামলাতে গিয়ে হিমসিম খেয়েছেন গডকড়ী। অনেকেই মনে করছেন, এর ফলে পরিকাঠামো ক্ষেত্রে মোদী ঠিক যা যা করতে চেয়েছিলেন, তা অনেকাংশেই করা যায়নি। এক মন্ত্রকের ভাবনা থেকে প্রধানমন্ত্রী এখনও সরে আসেননি ঠিকই, কিন্তু গডকড়ীর জায়গায় অন্য কাউকে নিয়ে আসা যায় কি না, তা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা শুরু হয়ে গিয়েছে।

স্মৃতি ইরানি মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী। তাঁর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সম্পর্কও ভাল। তবু মন্ত্রিত্বের প্রথম দিন থেকেই তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে বিরোধীদের আক্রমণের মুখে পড়েছে মোদী সরকার। কোনও রকম পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়া স্মৃতিকে পূর্ণমন্ত্রী করায় দলেরও অনেকে ক্ষুব্ধ। উপরন্তু আরএসএস নেতারা শিক্ষা মন্ত্রকের উপরে মতাদর্শগত নিয়ন্ত্রণ আরও বাড়াতে চাইছেন। কিন্তু স্মৃতি সেটা হতে দিচ্ছেন না। এই অবস্থায় সঙ্ঘের প্রস্তাব হল, স্মৃতিকে অন্য কোনও মন্ত্রকে পূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হোক, কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রকে এমন কাউকে আনা হোক যাঁর সঙ্গে সঙ্ঘের যোগসূত্র আরও নিবিড়। যেমন একদা ছিল মুরলীমনোহর জোশীর।

প্রকাশ জাভড়েকর পরিবেশ এবং তথ্য ও সম্প্রচার দু’টি মন্ত্রক সামলাতে হিমসিম খাচ্ছেন। পরিবেশমন্ত্রী হিসেবে গত চার মাসে তিনি শিল্পক্ষেত্রে এমন অনেক ছাড়পত্র দিয়েছেন, যাতে সঙ্ঘ অখুশি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি ছাড়া জাভড়েকর এই সমস্ত ছাড়পত্র দিয়েছেন, এটা ভাবাও কষ্টকর। ইউপিএ জমানায় জয়রাম রমেশ থেকে জয়ন্তী নটরাজন পরিবেশমন্ত্রীরা এত বেশি রক্ষণশীল মনোভাব নিয়েছিলেন যে, শিল্পমহল ভয়ঙ্কর চটে গিয়েছিল। আপাতত সেই ক্ষোভ প্রশমিত করাটা মোদী সরকারের প্রাথমিক লক্ষ্য। তবে ক্রমশ বোঝা যাচ্ছে, জাভড়েকরের পক্ষে দু’টি মন্ত্রক চালানো কঠিন। সে ক্ষেত্রে স্মৃতিকে পরিবেশ মন্ত্রকে নিয়ে আসার কথা হচ্ছে।

তবে রদবদলের আগে আরও দু-একটি দিক ভেবে রাখতে হচ্ছে মোদীকে। প্রথমত, মন্ত্রিসভায় এখনও বেশ কিছু রাজ্যের সুষ্ঠু প্রতিনিধিত্ব নেই। দ্বিতীয়ত, বয়সজনিত কারণে হিমাচলপ্রদেশের শান্তাকুমার, বিহারের ভূমিহার নেতা সি পি ঠাকুরের মতো নেতাদের মন্ত্রিসভার বাইরে রাখা হয়। সেই বিধিনিষেধ এ বার প্রত্যাহার করা হবে কি না, তা-ও দেখার। তবে মন্ত্রীদের মূল্যায়নের কাজটি প্রধানমন্ত্রী নিজেই করে থাকেন। রদবদলে সেই মূল্যায়নও বড় ভূমিকা নেবে বলে মনে করা হচ্ছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন