এ বার জালে তেহসিন, আইএম আরও দুর্বল

একটি আঘাত হজম করে ওঠার আগেই ফের বড়সড় ধাক্কা খেল ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন (আইএম)। দায়িত্ব নেওয়ার সাত মাসের মাথায় ধরা পড়ে গেল জঙ্গি সংগঠনটির ‘অপারেশনাল চিফ’ তেহসিন আখতার ওরফে মনু। মঙ্গলবার দিল্লি পুলিশের বিশেষ সেল-এর গোয়েন্দারা বিহারে, ভারত-নেপাল সীমান্তের কাঁকরভিটার কাছ থেকে তাকে গ্রেফতার করেছেন।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ২৬ মার্চ ২০১৪ ০২:৫১
Share:

তেহসিন আখতার

একটি আঘাত হজম করে ওঠার আগেই ফের বড়সড় ধাক্কা খেল ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন (আইএম)। দায়িত্ব নেওয়ার সাত মাসের মাথায় ধরা পড়ে গেল জঙ্গি সংগঠনটির ‘অপারেশনাল চিফ’ তেহসিন আখতার ওরফে মনু। মঙ্গলবার দিল্লি পুলিশের বিশেষ সেল-এর গোয়েন্দারা বিহারে, ভারত-নেপাল সীমান্তের কাঁকরভিটার কাছ থেকে তাকে গ্রেফতার করেছেন। দিল্লি পুলিশের ওই সেলের ডেপুটি কমিশনার সঞ্জীবকুমার যাদব এ কথা জানিয়েছেন। গত অক্টোবরে পটনায় নরেন্দ্র মোদীর সভাস্থলে ও শহরের অন্যান্য স্থানে ধারাবাহিক বিস্ফোরণের মামলায় মূল চক্রী হিসেবে অভিযুক্ত এই তেহসিন।

Advertisement

দিল্লি পুলিশ গত শুক্র ও শনিবার দু’দিনে আইএমের চাঁই, পাক নাগরিক জিয়া-উর-রহমান ওরফে ওয়াকাস ও তার তিন সহযোগীকে রাজস্থান থেকে গ্রেফতার করেছে। তার তিন দিনের মধ্যে তেহসিন গ্রেফতার হওয়ায় আইএমের কোমরই ভেঙে দেওয়া গেল বলে জাতীয় তদন্ত সংস্থা (এনআইএ), ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর (আইবি) গোয়েন্দারা মনে করছেন। লোকসভা ভোট শুরু হওয়ার আড়াই সপ্তাহ আগে তেহসিন ধরা পড়ায় নির্বাচন চলাকালীন আইএমের নাশকতার পরিকল্পনায় অনেকটাই জল ঢেলে দেওয়া গেল বলেও গোয়েন্দাদের একাংশ মনে করছেন।

গত বছর ২৯ অগস্ট ইয়াসিন ভটকল ধরা পড়ার পর ভারতে আইএমের দায়িত্ব নেয় তেহসিন। বিস্ফোরক সংগ্রহ করার সূত্রে কলকাতায় আনাগোনা ছিল ইয়াসিনের। তার উত্তরসূরি তেহসিনও একাধিক বার কলকাতায় এসেছে বলে গোয়েন্দাদের একটি অংশের দাবি। তাঁদের বক্তব্য, আইএমের আর এক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য কাতিল আহমেদ সিদ্দিকির সঙ্গেই সম্ভবত ২০১১ সালে কলকাতায় এসেছিল মনু। ছিল বেনিয়াপুকুর এলাকায়। বর্ধমান জেলা ও কলকাতার বন্দর এলাকার কাছে আইএমের দু’টি স্লিপার সেল চলছে। সে দু’টি তৈরির পিছনেও তেহসিনই।

Advertisement

ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র হওয়ায় তেহসিন অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সাজ-সরঞ্জাম ব্যবহারে বেশ দড়। বছর চব্বিশের এই যুবকের বাড়ি বিহারে, সমস্তিপুর জেলার মনিয়ারপুর গ্রামে। ইয়াসিন ভটকলের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে বিস্ফোরক দিয়ে আইইডি তৈরি করা ও তাতে টাইমার ডিভাইস লাগিয়ে বিস্ফোরণ ঘটানোর বিদ্যায় সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠেছিল সে। তার নেতৃত্বে বড় নাশকতা বলতে মোদীর সভাস্থল পটনার গাঁধী ময়দান ও শহরের অন্যত্র ধারাবাহিক বিস্ফোরণ। গত ২৭ অক্টোবরের ওই বিস্ফোরণে ৬ জন নিহত এবং আরও ৮৫ জন আহত হন। তেহসিনকেই মূল চক্রী হিসেবে উল্লেখ করে মামলা রুজু করা হয়। পটনা বিস্ফোরণ কাণ্ডে ধৃত আইএম জঙ্গি ইমতিয়াজ আনসারি পুলিশকে জানায়, মোদীর সভাস্থলে নাশকতা ঘটাতে তেহসিন অক্টোবরের গোড়ায় রাঁচিতে বিস্ফোরক তুলে দিয়েছিল হামলাকারীদের হাতে। তাকে ধরার জন্য এনআইএ ১০ লক্ষ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিল দু’বছর আগেই। কিন্তু পটনার ওই ধারাবাহিক বিস্ফোরণের পর থেকে তেহসিনকে এক রকম গরু-খোঁজা খুঁজছিল পুলিশ।

গোয়েন্দাদের দাবি, তেহসিন দেশের নানা প্রান্তে আরও অনেক নাশকতায় জড়িত। তার মধ্যে রয়েছে, ২০১০-এ দিল্লির জামা মসজিদের উল্টো দিকে ও বারাণসীর শীতলা ঘাটে বিস্ফোরণ, ২০১১-তে মুম্বইয়ের জাভেরি বাজার, অপেরা হাউস, দাদার ওয়েস্টে ধারাবাহিক বিস্ফোরণ, ২০১২-তে পুণেতে অল্প শক্তির বিস্ফোরণ এবং গত বছর হায়দরাবাদে জোড়া বিস্ফোরণ ও বুদ্ধগয়ায় ধারাবাহিক বিস্ফোরণ। ওই সব নাশকতায় অন্তত ৫০ জন নিহত ও ২৫০ জন আহত হন। গোয়েন্দাদের দাবি, তেহসিন নিজে দাদার স্টেশনের ফুট ওভারব্রিজে ও হায়দরাবাদের দিলখুশনগরে আইইডি বসিয়েছিল।

হায়দরাবাদ বিস্ফোরণের পরে তেহসিন গা ঢাকা দেয় রাজস্থানে। আশ্রয় নেয় জয়পুর ও জোধপুরের মতো শহরে। কিছু দিনের মধ্যে তৈরি করে ফেলে আইএমের রাজস্থান মডিউল বা গোষ্ঠী। পুলিশ সূত্রে আবার এ-ও জানা গিয়েছে, পটনা বিস্ফোরণের পরপর তেহসিন ও পাক নাগরিক ওয়াকাস মুজফ্ফরপুরে একটি স্কুলে শিক্ষকতাও করেছে কিছু দিন। সেই সময়ে তারা মোতিহারির বাসিন্দা বলে পরিচয় দিত।

দিল্লি পুলিশের বক্তব্য, রাজস্থানের অজমের, জয়পুর ও জোধপুর থেকে গ্রেফতার হওয়া আইএমের চাঁই ওয়াকাস ও সংগঠনের রাজস্থান মডিউলের তিন সদস্যকে জেরা করে পাওয়া তথ্য ইয়াসিনকে ধরার ক্ষেত্রে সাহায্য করেছে। স্পেশ্যাল কমিশনার এস এন শ্রীবাস্তব বলেন, “জামা মসজিদে বিস্ফোরণ ঘটাতে ২০১০-এর সেপ্টেম্বরে পাক নাগরিক ওয়াকাস কাঠমান্ডু বিমানবন্দরে নামে। সেখান থেকে তাকে দিল্লি নিয়ে গিয়েছিল তেহসিনই।” এই ধরনের কাজের জন্য তেহসিনকে পাকিস্তানে বসে বরাবরই নির্দেশ দিয়েছে আইএমের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা রিয়াজ ভটকল।

দিল্লিতে এক গোয়েন্দা অফিসার বলেন, “তেহসিন লোকসভা ভোটের সময় নাশকতার ছক কষছিল। ওই কাজে ব্যবহারের জন্য হাওয়ালার মাধ্যমে কয়েক লক্ষ টাকা পৌঁছনোর কথা ছিল তার হাতে।” দিল্লি পুলিশের দাবি, তেহসিনের মতলব ছিল একটি প্রতিবেশী দেশ থেকে ভারত হয়ে আর একটি প্রতিবেশী দেশে ঢোকা। আইএম শীর্ষ নেতৃত্ব তাকে জানিয়েছিল, তার জন্য সেখানে নিরাপদ আশ্রয়ের বন্দোবস্ত হয়েছে। দ্বিতীয় দেশটিতে যাওয়ার পথে ভারতে ঢুকেই ধরা পড়ে যায় মনু।

তেহসিন ২০১১ থেকে ঘরছাড়া। তার বাবা, পেশায় কেমিস্ট ওয়াসিম আখতার পুলিশকে একাধিক বার সে কথা জানিয়েছেন। ২০১১-র নভেম্বরে কলকাতা পুলিশের স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্স (এসটিএফ)-এর সহযোগিতায় দ্বারভাঙা মডিউলের হদিস পায় দিল্লি পুলিশের স্পেশ্যাল সেল। তার পর থেকে আইএম সদস্যরা একের পর এক গ্রেফতার হলেও ঘন ঘন ডেরা বদল করায় তেহসিন এত দিন অধরাই থেকে গিয়েছিল। গত অগস্টে ম্যাঙ্গালোরের একটি ডেরায় হানা দিয়ে পুলিশ অল্পের জন্য ধরতে পারেনি তাকে।

গোয়েন্দাদের দাবি, তেহসিন ধরা পড়ার পর ভারতে আইএম চাঁইদের মধ্যে অধরা রইল শুধু ঔরঙ্গাবাদের হায়দার আলি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement