আকাশে চক্কর কাটতে কাটতে নীচে সতর্ক দৃষ্টি রাখবে এক দঙ্গল ‘ড্রোন’। উড়বে ‘অ্যারোস্ট্যাট’ (চালকের কেবিন ও অত্যাধুনিক নজরদারি ব্যবস্থা-সহ অতিকায় গ্যাসবেলুন)। মহাকাশ থেকে কয়েক ঘণ্টা শুধু দিল্লির রাজপথেই চোখ রাখবে একাধিক মার্কিন উপগ্রহ। আর মাটিতে রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে ইন্ডিয়া গেট, সামান্যতম গতিবিধিও নিরন্তর জরিপ করে চলবে ভারতীয় ও মার্কিন গোয়েন্দাদের যৌথ দল। তার আগেই অবশ্য বিস্ফোরক খুঁজতে আমেরিকা থেকে উড়ে আসবে ৪০টি প্রশিক্ষিত জার্মান শেফার্ড কুকুর। একাধিক কুইক রেসপন্স টিম (কিউআরটি) ঘাঁটি গেড়ে থাকবে রাজপথের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে।
প্রেসিডেন্ট আসছেন যে!
বছরের শেষ সপ্তাহে কুয়াশায় আচ্ছন্ন গোটা রাজধানী। দৃশ্যমানতা নেই বললেই চলে। তার মধ্যে মার্কিন গোয়েন্দাদের চাপে ‘মক ড্রিল’ চালাতে গিয়ে দিল্লির ঠান্ডাতেও রীতিমতো গলদঘর্ম দশা দিল্লির গোয়েন্দাদের।
উপায়ই কী? এক মাসও বাকি নেই, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজের প্রধান অতিথি হয়ে দিল্লি আসছেন বারাক ওবামা। ২৬ জানুয়ারি ঘণ্টা দুয়েকের জন্য মোদী ও রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের পাশে বসে কুচকাওয়াজ উপভোগ করবেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
কিন্তু দু’ঘণ্টা ধরে ‘পোটাস’ (President of the United States POTUS. রাষ্ট্রপ্রধানকে এই সাঙ্কেতিক নামেই ডাকেন এফবিআই গোয়েন্দারা) বসে থাকবেন রাজপথে! তা-ও আবার খোলা আকাশের নীচে! কয়েক হাজার মানুষের ভিড়ে খোলা রাস্তায় মার্কিন প্রেসিডেন্টের এ ভাবে দু’ঘণ্টা বসে অনুষ্ঠান দেখার কোনও টাটকা উদাহরণ রয়েছে কি না, মনে করতে পারছেন না স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কর্তারাও। স্বভাবতই ২৬ জানুয়ারি মার্কিন প্রশাসন যে বিন্দুমাত্র ঝুঁকি নিতে নারাজ, তা হাড়ে হাড়ে বুঝছেন দিল্লির গোয়েন্দারা।
প্রস্তুতির বহর এতটাই যে, স্বল্প পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র হানা আটকাতে ‘অ্যারোস্যাট’ নিয়ে আসার কথা ভাবছে এফবিআই। বর্তমানে যা ব্যবহার হয়ে থাকে হোয়াইট হাউসের নিরাপত্তায়। ড্রোন, অ্যারোস্যাট, উপগ্রহ সব মিলিয়ে ২৬শের সকালে রাজপথের ইঞ্চি-ইঞ্চি নখদর্পণে রাখতে চাইছে মার্কিন প্রশাসন। যাতে অবাঞ্ছিত কোনও গতিবিধি দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে ‘কিউআরটি’।
ভাবনা তো এমনি এমনি নয়! ওবামার সফরের সময়ে জঙ্গি হামলার আশঙ্কা রয়েছে বলে সতর্ক করেছে মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ। এই পরিস্থিতিতে ওবামার সুরক্ষা ব্যবস্থা খতিয়ে দেখতে গত কাল দিল্লিতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ তাঁর মন্ত্রকের কর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। মার্কিন প্রশাসনকে সব রকম সাহায্য করার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।
এফবিআই অবশ্য মাসখানেক আগে থেকেই নিজেদের মতো করে প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে। কুচকাওয়াজের দু’দিন আগে থেকে রাজপথের নিরাপত্তা ব্যবস্থা কার্যত তাদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করে রেখেছেন মার্কিন গোয়েন্দারা। দিল্লির যে হোটেলে ওবামার থাকার কথা, সেটি ইতিমধ্যেই সরেজমিনে দেখে গিয়েছে গোয়েন্দাদের একটি দল। হোটেলের সমস্ত কর্মচারীর নাড়িনক্ষত্র জানতে চেয়েছেন তাঁরা। কঠোর করতে বলেছেন হোটেলের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। হোটেল থেকে রাজপথে আসার সম্ভাব্য পথটি গোয়েন্দারা ‘রেকি’ করার পর তাতে একপ্রস্ত মহড়াও দিয়ে ফেলেছে ওবামার ডামি কনভয়। এমনকী কুচকাওয়াজ দেখতে আসা লোকেদেরও অতীত ইতিহাস খতিয়ে দেখা যায় কি না, জানতে চেয়েছে এফবিআই। পরিস্থিতি সরেজমিনে খতিয়ে দেখতে আগামী ৯ জানুয়ারি আরও একটি গোয়েন্দা দলের দিল্লি আসার কথা রয়েছে। দিল্লির পাশাপাশি তাজমহল ও মোদীর লোকসভা কেন্দ্র বারাণসী যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে ওবামার। ওই দুই শহরের নিরাপত্তা ব্যবস্থাও খতিয়ে দেখার কথা রয়েছে মার্কিন গোয়েন্দাদের।
সাধারণত কোনও রাষ্ট্রপ্রধান বিদেশ সফরে গেলে সংশ্লিষ্ট দেশের গোয়েন্দাদের উপরেই তাঁর নিরাপত্তার দায়িত্ব বর্তায়। আমন্ত্রিত রাষ্ট্রপ্রধানের গোয়েন্দাবাহিনী মূলত সমন্বয়ের কাজ করে। কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিষয়টি সম্পূর্ণ আলাদা। তাঁর নিরাপত্তা ব্যবস্থার আগাগোড়া দায়িত্ব থাকে মার্কিন গোয়েন্দাদের উপরেই। তাই যাত্রা শুরু থেকে শেষ, গোটাটাই চলে একেবারে ছক বেঁধে। আসন্ন সফরে যেমন দু’টি ‘এয়ার ফোর্স ওয়ান’ বিমান আসবে। একটিতে থাকবেন প্রেসিডেন্ট। অন্যটি ‘ডামি’। আমলা ও সাংবাদিকরা থাকবেন দু’টি আলাদা বিমানে। দু’টি এয়ার ফোর্স ওয়ান-কে গোটা যাত্রাপথে ঘিরে থাকবে গোটা চল্লিশেক ফাইটার জেট।
দিল্লিতে নামার পর ওবামার যাতায়াতের জন্য বরাদ্দ থাকবে ছ’টি কালো ক্যাডিলাক। সেগুলি ওয়াশিংটন থেকেই উড়িয়ে আনা হবে। কম-বেশি প্রায় পঞ্চাশটি গাড়ির কনভয়ের মধ্যে ওই অবিকল এক রকম দেখতে ছ’টি ক্যাডিলাকের একটিতে চড়ে হোটেল থেকে রাজপথে পৌঁছবেন ওবামা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের এক কর্তার কথায়, “জ্যামার-যুক্ত ওই গাড়িগুলো বড় মাপের বিস্ফোরণের ধাক্কা, এমনকী রাসায়নিক অস্ত্রের হামলাও সামলে নিতে পারে। ভিতরে আরোহীদের শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে অসুবিধে হবে না।” প্রেসিডেন্টের গাড়িকে বোঝাতে ‘দ্য বিস্ট’ নামটা ব্যবহার করেন মার্কিন গোয়েন্দারা। সেই ‘বিস্ট’-এ এমন অত্যাধুনিক প্রযুক্তি রয়েছে যে, ওই গাড়ি থেকে ফোন তুললেই সরাসরি হোয়াইট হাউস বা ভাইস প্রেসিডেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন প্রেসিডেন্ট। প্রয়োজনে ওই গাড়িতে বসেই পরমাণু হামলা চালাতে পারেন বিশ্বের যে কোনও প্রান্তে। প্রেসিডেন্টকে যাতে অনুষ্ঠানস্থল থেকে দ্রুত সরিয়ে এনে ‘বিস্ট’-এ তুলে দেওয়া যায়, সেই ব্যবস্থা করে রাখে এফবিআই। সেই কারণেই দিল্লির রাজপথের মঞ্চে বিশেষ ‘এসকেপ রুট’-এর জন্য দরবার করেছে তারা। এ ছাড়া রাজপথ সংলগ্ন সরকারি ভবনগুলিতে মার্কিন ‘স্নাইপার’ বন্দুকবাজ রাখারও প্রস্তাব দিয়েছে।
সব মিলিয়ে নাজেহাল দশা দিল্লির গোয়েন্দাদের। এমনিতেই প্রতি বছর প্রজাতন্ত্র দিবসের ভিভিআইপি-দের সুরক্ষা দিতে ঘুম উড়ে যায় তাঁদের। আর এ বার উপস্থিত খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট। ফলে ঘুম তো দূর অস্ৎ, নাওয়া-খাওয়াও ভুলেছেন তাঁরা।
নেতা আসছেন, নেতা আসছেন! বড় ঝক্কি ঝক্কি!