বিদ্যুৎ-মাসুলের বাড়বাড়ন্তে লাগাম পরাতে উৎপাদনকেন্দ্রে কয়লার জোগান-ব্যবস্থা ঢেলে সাজার পরিকল্পনা করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। তারা চাইছে প্রতিটি তাপ-বিদ্যুৎ কেন্দ্র যতটা সম্ভব নিকটবর্তী খনির কয়লা ব্যবহার করুক, যাতে পরিবহণ খরচ কমানো যায়। এ ভাবে বিদ্যুতের উৎপাদন-ব্যয় কমানো গেলে মাসুলও নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ হবে বলে দিল্লি মনে করছে।
বিষয়টি নিয়ে বিদ্যুৎ, কয়লা ও রেল মন্ত্রকের আধিকারিকেরা সম্প্রতি সব রাজ্যের বিদ্যুৎ উৎপাদক সংস্থার শীর্ষ কর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। অধিকাংশ বিদ্যুৎ সংস্থাই দিল্লির পরিকল্পনাকে স্বাগত জানিয়েছে। রাজ্য বিদ্যুৎ দফতরের এক মুখপাত্রের বক্তব্য: বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ যে ভাবে বছর বছর বাড়ছে, তার অন্যতম প্রধান কারণ কয়লার পরিবহণ ব্যয়বৃদ্ধি। ইউপিএ সরকারের আমলে সমস্যাটি সুরাহার ব্যাপারে ভাবনা-চিন্তা শুরু হয়েছিল। কেন্দ্রের নতুন বিজেপি সরকার এখন তা কার্যকর করতে সক্রিয় হয়েছে।
বিদ্যুৎ ব্যবহারের খরচ নিয়ন্ত্রণের উপায় খুঁজতে আন্তর্জাতিক একটি সংস্থাকে দিয়ে কেন্দ্র সমীক্ষা চালিয়েছিল। সমীক্ষা-রিপোর্ট বলছে, তাপ-বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কয়লা জোগানের চালু ব্যবস্থা পাল্টানো গেলে বছরে সাড়ে চার হাজার কোটি থেকে ছ’হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় সম্ভব। রিপোর্টের ভিত্তিতে কেন্দ্র প্রাথমিক ভাবে দেশের ২১টি তাপ-বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে চিহ্নিত করেছে। সেগুলো কোথা থেকে কয়লা নিলে আর্থিক সাশ্রয় হবে, তা-ও ঠিক করা হয়েছে।
এবং চিহ্নিত কেন্দ্রগুলির মধ্যে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের কোলাঘাট ও বক্রেশ্বর। দু’টিতেই বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় কয়লার সিংহভাগ আসে ওড়িশার মহানদী খনি থেকে। এখন কোলাঘাট-বক্রেশ্বরকে ঝাড়খণ্ডের বিসিসিএলের কয়লা নেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। প্রাথমিক ভাবে রাজ্যও জানিয়ে দিয়েছে, তাতে আপত্তি নেই।
সরকারি হোক বা বেসরকারি, কোন তাপ-বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কোন খনি কয়লা জোগাবে, কেন্দ্রের কয়লা, বিদ্যুৎ ও রেল মন্ত্রক মিলে তা ঠিক করে। বিদ্যুৎ মন্ত্রকের এক কর্তা জানান, বহু পুরনো এই ব্যবস্থায় বিস্তর ফাঁক-ফোকর ধরা পড়েছে। দেখা যাচ্ছে, পঞ্জাবের কোনও বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কয়লা যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ থেকে। আবার ওড়িশায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিদেশি কয়লা আসছে গুজরাতের বন্দর হয়ে, রেলপথে। কোল ইন্ডিয়ার সঙ্গে তাপ-বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলির সেই মতোই চুক্তি হয়ে রয়েছে। “কিন্তু এতে সময় যেমন বেশি লাগছে, তেমন বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ বেড়ে যাচ্ছে বহু গুণ।” বলছেন কর্তাটি।
সংশ্লিষ্ট রাজ্যের খনি থেকেই কেন বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কয়লা সরবরাহের ব্যবস্থা হচ্ছে না? তাতে তো খরচ কমবে!
বিদ্যুৎ মন্ত্রকের এক আধিকারিকের ব্যাখ্যা, তাপ-বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলি রাজ্যের খনি থেকেও কয়লা নেয়। কোলাঘাট-বক্রেশ্বরে পশ্চিমবঙ্গের খনির কয়লাও আসে। কিন্তু কোনও বিদ্যুৎ কেন্দ্র রাজ্যের খনি থেকে কতটা কয়লা নিতে পারবে, তা নির্ধারণের অধিকারী কেন্দ্রীয় সরকার। কেননা দেশের যাবতীয় খনিজ সম্পদ কেন্দ্রের অধীনে। কোন কেন্দ্রে কী মানের কয়লা লাগবে, খনি-নির্বাচনের ক্ষেত্রে মন্ত্রক তা-ও খতিয়ে দেখে। সব মিলিয়ে বর্তমানে যে কোনও বিদ্যুৎ কেন্দ্রকেই প্রয়োজনের বেশির ভাগ কয়লা অন্য রাজ্য থেকে সংগ্রহ করতে হয়।
পশ্চিমবঙ্গ বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগমের এক শীর্ষ কর্তা জানান, বক্রেশ্বর-কোলাঘাটে বিসিসিএলের কয়লা ব্যবহারে তাঁদের তরফে প্রাথমিক ভাবে আপত্তি নেই। তবে দেখতে হবে, নতুন ব্যবস্থায় কয়লার খরচ আদৌ কমবে কি না। তাঁর কথায়, “বিসিসিএলের কয়লায় তাপ তুলনায় বেশি হয়। উল্টো দিকে মহানদীর কয়লার সুবিধা, এক বার আগুন দিলে চট করে নিভে যায় না।”
তা সত্ত্বেও চাহিদা মতো ঝাড়খণ্ডের কয়লা পাওয়ার আশ্বাস মিললে কেন্দ্রীয় প্রস্তাব মেনে নেওয়ারই ইঙ্গিত মিলেছে নিগম-সূত্রে।