কফিনে ফিরল ছেলের দেহ, শোকে স্তব্ধ বাবা

শেষ যাত্রাতেও মাথায় বাবার আশীর্বাদের হাত। শিক্ষামূলক ভ্রমণে মানালির উদ্দেশে রওনা হওয়ার আগে বাড়িতে জানিয়েছিলেন, পরীক্ষা শেষ। ছুটি কাটাতে মানালি যাচ্ছি সবাই। সুস্থ শরীরে ফিরে আসার কথা বলে আশীর্বাদ করেছিলেন বাবা। ফিরলেন ঠিকই, তবে কফিনবন্দি হয়ে। হায়দারবাদের সেন্ট জোসেফ ক্যাথিড্রাল গির্জায় শেষকৃত্যের সময় নীল হয়ে যাওয়া ছেলের মাথায় পরম স্নেহে হাত বুলিয়ে দিলেন বাবা।

Advertisement

সংবাদ সংস্থা

হায়দরাবাদ ও মান্ডি শেষ আপডেট: ১২ জুন ২০১৪ ০৩:২১
Share:

শেষ যাত্রায়। হায়দরাবাদের সেন্ট জোসেফ ক্যাথিড্রালে দেবাশিসের মরদেহের পাশে বাবা। ছবি: এপি।

শেষ যাত্রাতেও মাথায় বাবার আশীর্বাদের হাত।

Advertisement

শিক্ষামূলক ভ্রমণে মানালির উদ্দেশে রওনা হওয়ার আগে বাড়িতে জানিয়েছিলেন, পরীক্ষা শেষ। ছুটি কাটাতে মানালি যাচ্ছি সবাই। সুস্থ শরীরে ফিরে আসার কথা বলে আশীর্বাদ করেছিলেন বাবা।

ফিরলেন ঠিকই, তবে কফিনবন্দি হয়ে। হায়দারবাদের সেন্ট জোসেফ ক্যাথিড্রাল গির্জায় শেষকৃত্যের সময় নীল হয়ে যাওয়া ছেলের মাথায় পরম স্নেহে হাত বুলিয়ে দিলেন বাবা।

Advertisement

বুধবার ভোরে বিপাশার তীরে হানোগি এলাকা থেকে উদ্ধার হয়েছে ওই যুবকের দেহ। দুর্ঘটনাস্থল থেকে প্রায় ৩০০ মিটার দূরে বড়সড় একটি পাথরের নীচে আটকে ছিল সেটি। দেহটি শনাক্ত করেছেন তাঁর মা। জানা গিয়েছে, বছর কুড়ির ওই যুবকের নাম দেবাশিস বসু।

তিন দিনের চেষ্টায় বিপাশার নদীখাত থেকে এই নিয়ে ছ’জন ছাত্র-ছাত্রীর দেহ উদ্ধার করল বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী। এখনও নিখোঁজ ১৭ জন। খোঁজ মেলেনি ছাত্র-ছাত্রীদের সর্ব ক্ষণের সঙ্গী দক্ষ গাইডেরও।

ডুবুরিদের দলে এ দিন যোগ দিয়েছেন নৌ-সেনার তরফে পাঠানো আরও ন’জন। উদ্ধারকাজে নেমেছে আধাসামরিক বাহিনীও। সব মিলিয়ে বিপাশার নদীখাতে দিনভর তল্লাশি চালাচ্ছে ৫০০ জনের একটি দল। দুর্ঘটনাস্থল অর্থাৎ পানডো বাঁধ সংলগ্ন এলাকা থেকে ২০ কিলোমিটার বিস্তৃত অঞ্চলে চিরুনি তল্লাশি চালাচ্ছে তারা। বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর কম্যান্ডার জয়দীপ সিংহ এক বিবৃতিতে বলেন, “তলিয়ে যাওয়া ছাত্র-ছাত্রীদের বেঁচে থাকার আর কোনও সম্ভাবনা নেই। দিন দু’য়েকের মধ্যে বরং ফুলেফেঁপে ভেসে উঠবে তাঁদের দেহ।” জয়দীপ এ-ও জানান, জলের প্রচণ্ড স্রোতে প্রতিনিয়ত বিঘ্নিত হচ্ছে উদ্ধারকাজ। তবে চেষ্টার কোনও ত্রুটি রাখছেন না উদ্ধারকর্মীরা।

ছেলে ফিরে আসার আশায় এখনও বুক বেঁধে অধিকাংশ অভিভাবক। একমাত্র ছেলে অখিলের খোঁজে গত কালই কেন্দ্রীয় বিমানমন্ত্রী অশোক গজপতির সঙ্গে মান্ডি এসেছেন সঞ্জয় কুমার। আক্ষেপের সুরে বলছিলেন, “তিন দিন হয়ে গেল ছেলের কোনও খোঁজ দিতে পারছে না কেউ। আগামী কাল ওর জন্মদিন। ওকে সঙ্গে নিয়েই দিল্লি ফিরব আমি।”

এ দিকে খরস্রোতা বিপাশায় ২৪ জন ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্রের তলিয়ে যাওয়ার ঘটনায় এ দিন লারজি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে দায়ের করা হয়েছে গাফিলতির অভিযোগ। কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে এফআইআরটি করেছেন অধ্যাপক এ আদিত্য। হায়দরাবাদের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ৪৮ জন পড়ুয়া এবং দুই সহকর্মীকে নিয়ে মানালি সফরে গিয়েছিলেন তিনিও। ভাগ্যের ফেরে ফিরে এসেছেন প্রায় শূন্য হাতে। দু’দিন যাবৎ মান্ডিতেই রয়েছেন তেলঙ্গানার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নৈনি নরসিংহ রেড্ডি। পুরো ঘটনার জন্য লারজি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প কর্তৃপক্ষকে দায়ী করেছেন তিনি। এমনকী এ-ও বলেছেন, অভিযোগ প্রমাণিত হলে দোষীরা যথাযথ শাস্তি পাবে। ঘটনায় কলেজ কর্তৃপক্ষের গাফিলতি থাকলে রেহাই পাবেন না তাঁরাও।

মঙ্গলবার রাতেই হায়দরাবাদ ফিরে এসেছেন উনিশ বছরের রঘুবেন্দ্র কলামু। চোখের সামনে কয়েক সেকেন্ডের ফারাকে বন্ধুদের তলিয়ে যাওয়ার স্মৃতি এখনও তাড়া করে বেড়াচ্ছে তাঁকে। কাঁপা কাঁপা গলায় জানালেন, রবিবার সন্ধে সাড়ে ছ’টা নাগাদ নদীতে নেমেছিলেন তাঁরা। বিপাশার খাতে তখন গোড়ালি-জলও ছিল না। হঠাৎই জল বাড়তে শুরু করে। টাল সামলাতে না পেরে পড়ে যান। কোনও রকমে সাঁতরে পাড়ে উঠে এসেছিলেন। তবে হাঁপ ফেলার সুযোগ পাননি। সহপাঠীদের বাঁচাতে স্রোতের মুখে পাড় ধরে ছুটে গিয়েছিলেন প্রায় ৩-৪ কিলোমিটার। ভেসে উঠছিল কারও কারও মাথা। পাড় থেকে ছুড়ে দেওয়া দড়ি, লাঠিতে ভর করে ডাঙায় উঠে আসতে পেরেছিলেন তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ।

রঘুবেন্দ্রর ক্ষোভ, হাতের কাছে লাইফ জ্যাকেট, বোট পাওয়া গেলে হয়তো বেঁচে যেত আরও কিছু জন। এখনও পর্যন্ত যে ছয় ছাত্র-ছাত্রীর দেহ উদ্ধার হয়েছে তাঁদের মধ্যে তিন জন রঘুবেন্দ্রর ঘনিষ্ঠ ছিলেন। চোখের কোণে জল, থমথমে শান্ত মুখ। প্রিয় বন্ধুদের হারিয়ে তরুণ বলে চললেন, “ঐশ্বর্যা এরোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন দেখত, বিষ্ণু বলত ইঞ্জিনিয়ারিং ছেড়ে যদি ব্যাডমিন্টন খেলতে পারতাম তাহলেই বোধ হয় ঢের ভাল হতো। আর সাবির ভাবত এক দিন ঠিক বড় গায়ক হবে ও।”

ঐশ্বর্যা-বিষ্ণু-সাবিরের স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেল!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন