সে এক পাহাড়ি গ্রামে ছিলেন দুই ভাই। পিঠোপিঠি।
দু’জনের মধ্যে বেজায় খিটিমিটি। পঁচাত্তুরে সিংলামপাও খাও আর চুয়াত্তুরে গাদাই খাও দুই দাদুরই বড় সাধ, গ্রামপ্রধান হবেন। কিন্তু একসঙ্গে দু’জন গাঁওবুড়ো তো হয় না! দিন গেল, মাস গেল, দশ-দশটা বছর গেল ঝগড়া আর মিটল না। নিজেরা পথ খুঁজে না পেয়ে দু’ভাই কত্তো চিঠি লিখলেন বিডিও থেকে ডিএম, মায় রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে। কেউ একটা সাড়াও দিল না!
এ দিকে বয়স তো বেড়েই চলে। কবে আছি কবে নেই দুই বুড়োর আর তর সয় না। এ বার হয় এসপার নয় ওসপার। একদিন টুকটুক করে গ্রামসভাকে গিয়ে তাঁরা বললেন, ‘‘তোমরাই না হয় একটা ব্যবস্থা করো। এ ভাবে তো চলে না!”
মণিপুরের গাতাও গ্রামসভা পড়ল মহা চিন্তায়। এ তো আর রাজকন্যে নিয়ে যুদ্ধ নয়। আর সত্তর পেরোনো মানুষদু’টোকে কুস্তি লড়তে নামিয়ে দেওয়াটাও বাড়াবাড়ি। কিন্তু খাও-ভাইরা নাছোড়। নিদান যা-ই হোক, লড়ে যাব।
অগত্যা একটা ‘বন্ধুর’ পথের গপ্পো শোনানো হল তাঁদের ‘জলপথ’। দু’জনেই ডুব দাও পুকুরে। যে বেশিক্ষণ জলের তলায় দমবন্ধ করে থাকতে পারবে, কুর্সি তার! গাতাও যে জেলায়, সেই তামেংলং কিংবা উখরুলে গ্রামের নানা ঝগড়া এ ভাবে মেটানোর চল রয়েছে। কিন্তু দাদুরা পারবেন তো? মাসটা ডিসেম্বর, জাঁকিয়ে ঠান্ডা।
পিছিয়ে যাওয়া তো দূর, দু’জনে আরও চাঙ্গা হয়ে উঠলেন যেন। কুছ পরোয়া নেই। দেখা হবে রবিবার। চ্যালেঞ্জ নিবি না... ভাই! চুয়াত্তর আর পঁচাত্তর মেপে নিলেন পরস্পরকে।
১৪ ডিসেম্বর, ২০১৪। গ্রামবাসীদের চোখের সামনেই শুরু হল জলের লড়াই। মূলত নাগাজাতির বাস এই গ্রামে। পুকুর ঘিরে তুমুল ভিড়। গরমজামার ধড়াচুড়ো ছেড়ে হিমঠান্ডা জলে ডুব দিলেন সিংলামপাও আর গাদাই খাও।
এক দৃষ্টিতে জলের দিকে তাকিয়ে সবাই। দু-তিন মিনিট কেটে গেল। এখনও কেউ মাথা তোলেনি জল থেকে। পাড়ে জড়ো হওয়া ভিড় হাততালি দিচ্ছে ফটাফট। লড়ে যাও দাদুরা! হাসি-মস্করা, চেঁচিয়ে উৎসাহ দেওয়াও চলতে থাকে সমান তালে।
আরও খানিকটা সময় পেরোয়। কেউ ওঠে না। পাড়ের ভিড়ে ফিসফাস। এ বার না হয় বলেই দেওয়া যাক, রক্ষে করো বাপুরা! তোমাদের ঝগড়া না হয় পরে মেটানো যাবে। ফুসফুসগুলো কি আর পঁচিশ বছরের ছোকরাদের মতো আছে? অনেকেরই একটু ভয়-ভয় করে। শেষে জলে নেমেই পড়েন কয়েক জন। ডুব দিয়ে দেখেন, জলের অনেক তলায় নিথর পড়ে রয়েছেন দুই বুড়ো।
তক্ষুনি জল থেকে তুলে আনা হয় দু’জনকে। তখন তাঁরা ঠান্ডা। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরেও আর চোখ মেলে তাকাননি।
পুলিশ এল। রাগে-দুঃখে গ্রামের লোক বলল, যত দোষ সরকারের। খাও-দাদুদের চিঠি পড়ে ঝগড়াটা মিটিয়ে দিলেই এমন হতো না!