চনমনে ছোট মন্ত্রিসভাই লক্ষ্য মোদীর, আজ প্রণবের কাছে

নাদুস-নুদুস নয়, ছিপছিপে মন্ত্রিসভা চাইছেন নরেন্দ্রভাই মোদী। গুজরাতে এটাই ছিল তাঁর সাফল্যের মন্ত্র। এ বারে কেন্দ্রেও ছোট অথচ সক্ষম মন্ত্রিসভা গড়াই তাঁর ইচ্ছে। তার আগে অবশ্য রয়েছে আনুষ্ঠানিক কিছু কাজ। যা কালকেই সেরে ফেলবে এনডিএ। কাল সকালেই এনডিএ-র সংসদীয় দলের নেতা নির্বাচিত করা হবে মোদীকে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২০ মে ২০১৪ ০৩:১৪
Share:

ভাবী প্রধানমন্ত্রীকে শুভেচ্ছা জগন্মোহন রেড্ডির। দিল্লিতে। ছবি: পিটিআই

নাদুস-নুদুস নয়, ছিপছিপে মন্ত্রিসভা চাইছেন নরেন্দ্রভাই মোদী। গুজরাতে এটাই ছিল তাঁর সাফল্যের মন্ত্র। এ বারে কেন্দ্রেও ছোট অথচ সক্ষম মন্ত্রিসভা গড়াই তাঁর ইচ্ছে। তার আগে অবশ্য রয়েছে আনুষ্ঠানিক কিছু কাজ। যা কালকেই সেরে ফেলবে এনডিএ। কাল সকালেই এনডিএ-র সংসদীয় দলের নেতা নির্বাচিত করা হবে মোদীকে। এর পর সরকার গড়ার দাবি জানাতে বেলা আড়াইটে নাগাদ এনডিএ প্রতিনিধিরা যাবেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কাছে। মোদী নিজে রাষ্ট্রপতি ভবনে যাবেন সওয়া তিনটেয়। সরকার গড়ার ডাক পেতে। সব ঠিকঠাক থাকলে সম্ভবত ২৫ তারিখ, অর্থাৎ আগামী রবিবার সন্ধে ছ’টা নাগাদ হতে পারে শপথ গ্রহণ। শপথ নিতে পারে মোদী-সহ ১৫-২০ জনের মন্ত্রিসভা।

Advertisement

তবে এই সব আনুষ্ঠানিকতার আগে গত কাল থেকেই মোদী মন্ত্রিসভা গঠনের তোড়জোর শুরু করে দিয়েছেন। ঘনিষ্ঠ নেতাদের তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, যে গুজরাত মডেলের সাফল্যকে পুঁজি করে তিনি গোটা দেশে প্রচার করেছেন, সেই সরকারে পূর্ণমন্ত্রী মাত্র ৮ জন। প্রতিমন্ত্রীর সংখ্যা ১৫। সকলের হাতেই ঠাসা মন্ত্রক। মোদী মনে করেন, সরকার চালানোর জন্য বেশি মন্ত্রীর প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন নীতি রূপায়ণ করে সেই অনুযায়ী কাজ করা। দেশের সব কিছুর দায়িত্ব সরকার ঘাড়ে নেবে, সেটা হতে পারে না। ফলে প্রথমেই তিনি এটা স্পষ্ট করে দিতে চান, সরকার কী করবে ও কী করবে না। আর এই ধাক্কাটা দিয়েই সরকারের কাজ শুরু করতে চাইছেন মোদী। ছোট মন্ত্রিসভা গঠন তারই প্রথম ধাপ।

মোদীর লক্ষ্যই হল, সরকারের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে দেশ চালানো। এ বারের নির্বাচনে গোটা প্রচারপর্বেই মোদী বলে এসেছেন, বহরে সব চেয়ে ছোট সরকার কিন্তু কাজে সব চেয়ে বেশি। মোদীর ভাষায়, “মিনিমাম গভর্মেন্ট, ম্যাক্সিমাম গভর্নেন্স।” সেই নীতি মেনেই এ বার মন্ত্রিসভা গড়তে চান তিনি।

Advertisement

মোদী-ঘনিষ্ঠ এক নেতা আজ বলেন, “মোদী যদি নিজের ভাবনা অনুযায়ী মন্ত্রিসভা গড়তে পারেন, তবে ২০-২৫ জনের বেশি মন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সমস্যা হল মন্ত্রী হয়ে সরকারে গুরুত্ব পেতে চান অনেকেই। মোদী আপাতত সকলের কথা শুনছেন। তবে শেষ পর্যন্ত কী করতে পারবেন, সেটাই দেখার।” বস্তুত নিজের পছন্দ মতো সরকার গড়তে দু’টি জট কাটাতে হবে মোদীকে। এক তো অবশ্যই বহু দিন ধরে বড় কলেবরের মন্ত্রিসভা গঠনের যে প্রথা চলছে, সেটাকে ভাঙা। এবং সেই সঙ্গে কাজের ক্ষেত্রে সরকার যাতে আরও পারদর্শী হয়, সমন্বয় বাড়ে, তা নিশ্চিত করা। দ্বিতীয়টি হল, দল ও সঙ্ঘের প্রত্যাশা মেটানো। বহরে ছোট অথচ তৎপর মন্ত্রিসভা গড়তে গেলেই অনেকে আশাহত হবেন। এর উপরে রয়েছে নেতাদের সম্পর্কের টানাপড়েন। এ সব দিক মাথায় রেখে একটা বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত নিতে হবে মোদীকে।

এটা ঘটনা যে ভোটের বিপুল সাফল্য মোদীকে অনেকটাই বাড়তি শক্তি জোগাবে এ ক্ষেত্রে। এ ছাড়া দেশের বণিক মহলও এখন প্রকাশ্যেই সওয়াল করছে ছোট মন্ত্রিসভার পক্ষে। বণিকসভা ফিকি-র সভাপতি সিদ্ধার্থ বিড়লা যেমন এ দিন বলেছেন, “আমাদের বহু মন্ত্রক রয়েছে। এত মন্ত্রক রাখার প্রয়োজন নেই। মন্ত্রিসভার বহর কমাতে বিদ্যুৎ, খনি, ইস্পাত, পরিকাঠামো সংক্রান্ত অন্যান্য মন্ত্রক একই ছাতার তলায় কাজ করতে পারে। তা হলে শিল্প ক্ষেত্রে সরকারি হস্তক্ষেপ ও নানা রকমের ছাড়পত্র নেওয়ার সমস্যা কমবে।” একই ধরনের কাজ করে এমন দু’-তিনটি মন্ত্রককে ভবিষ্যতে মিশিয়েও দেওয়া যেতে পারে বলে বিড়লার মত।

তবে এর মধ্যেও মোদীকে কিন্তু এগোতে হচ্ছে যতটা সম্ভব ঐকমত্যের ভিত্তিতে। তিনি জানেন, দলের অভিজ্ঞ নেতাদের মন্ত্রকে সামিল করতেই হবে। কিন্তু এক জনের সঙ্গে আর এক জনের বিষয়টি ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। অরুণ জেটলির মতো নেতারা যেমন লালকৃষ্ণ আডবাণীকে স্পিকার করার ব্যাপারে আপত্তি জানাচ্ছেন। তেমনই আডবাণী গত কাল মোদীকে বলেছেন, ভোটে হেরে যাওয়া জেটলিকে অর্থমন্ত্রী করলে ভুল বার্তা যাবে। আবার রাজনাথ সিংহকে মোদী মন্ত্রী করতে চাইলেও সঙ্ঘের একাংশ তাঁকে সভাপতি পদেই রাখতে উদ্যোগী। এই অবস্থায় মোদী তাড়াহুড়ো করতে চাইছেন না। কারণ, সরকার গড়ার সময় তিনি এমন কোনও পদক্ষেপ করতে চাইছেন না, যাতে দলের কেউ প্রকাশ্যে কিছু বেসুরো না বলে বসেন। তাই তিনি সকলের সঙ্গে দেখা করছেন। কিন্তু মুখে কিছু বলছেন না। সকলের মত শুনেই তিনি সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবতের সঙ্গে আলোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন।

ছোট মন্ত্রিসভার লক্ষ্যে স্থির থেকে নেতানেত্রীদের আশাপ্রত্যাশার জট ছাড়ানোর কাজে মোদীর পাশাপাশি সমান সক্রিয় রাজনাথ ও সঙ্ঘ নেতৃত্বও। তাঁরাও দফায় দফায় বৈঠক করছেন বিজেপি নেতাদের সঙ্গে। গত কাল আডবাণীর সঙ্গে বৈঠকের পর আজ সুষমা স্বরাজের সঙ্গে দেখা করেন মোদী। বরুণ গাঁধী, উমা ভারতী, নাজমা হেপতুল্লা, সি পি ঠাকুর, অনুরাগ ঠাকুর, গোপীনাথ মুন্ডে, বিজয় গোয়েল আজ রাজনাথের সঙ্গে দেখা করেন। এসেছিলেন, অজিত সিংহের মতো নেতাকে হারিয়ে সাংসদ হওয়া প্রাক্তন মুম্বই পুলিশ কমিশনার সত্যপাল সিংহও। তামিলনাড়ুর নেতা ভাইকো, জগন্মোহনও আজ দেখা করতে যান মোদীর সঙ্গে।

সীমান্ধ্রে চন্দ্রবাবু নায়ডুর সঙ্গে ভোটের আগে জোট গড়ে বিজেপি নির্বাচন লড়েছে। সেই রাজ্যে ক্ষমতায় এলে চন্দ্রবাবু যাতে জগন্মোহনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত নিয়ে বেশি বেগ না দেন, সেই আর্জি নিয়েই মোদীর সঙ্গে সাক্ষাৎ তাঁর। বিজেপির শরিক অকালি নেতা প্রকাশ সিংহ বাদল আজই ঘোষণা করে দিয়েছেন, মোদীর মন্ত্রিসভায় সামিল হবে না তাঁর দল।

গত কালই মন্ত্রিসভার একটি সম্ভাব্য তালিকা তৈরি করার জন্য জেটলিকে বলেছিলেন মোদী। সেই তালিকা তৈরি করে আজ সকালে গুজরাত ভবনে মোদীর সঙ্গে বৈঠক করেন জেটলি। সেখানে মোদীর ঘনিষ্ঠ নেতা অমিত শাহও উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু জট না কাটায় সন্ধেয় জেটলি ফের মোদীর সঙ্গে দেখা করতে যান। আগামিকাল সকালে সংসদের সেন্ট্রাল হলে বিজেপির নতুন সাংসদদের নিয়ে বৈঠক। তার পর এনডিএর নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে স্থির হবে কবে শপথ নেবেন মোদী।

দলের সূত্রের খবর, শপথ নেওয়ার দিন মোদী সব মন্ত্রীদের নাম চূড়ান্ত না-ও করতে পারেন। প্রথম দফায় মুষ্টিমেয় কয়েক জন শপথ নিতে পারেন মোদীর সঙ্গে। পরে প্রয়োজন অনুসারে মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণ হতে পারে। শপথ নেওয়ার দিনেও অভিনবত্ব আনতে চাইছেন মোদী। সেই দিন রাষ্ট্রপতি ভবনের সামনের ফোর-কোর্টে খোলা আকাশের নীচে শপথ নিতে চান তিনি। দিনের বেলায় গরমের কথা মাথায় রেখে সন্ধেয় এই কর্মসূচি করার প্রস্তাব রয়েছে।

দলের সূত্রের মতে, অটলবিহারী বাজপেয়ী, এমনকী মনমোহন সিংহের মন্ত্রিসভার কলেবরও ছিল অনেক বড়। বাজপেয়ী সরকারে ১৬ জন পূর্ণমন্ত্রী, ৮ জন স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী ও ২২ জন প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। মনমোহন জমানায় এই সংখ্যা বেড়ে যায় অনেকটাই। পূর্ণমন্ত্রী ২৯ জন, স্বাধীন দায়িত্বে ১২ জন ও ২৯ জন প্রতিমন্ত্রী। রাজ্যগুলিতেও মুখ্যমন্ত্রীরা অনেক বড় মন্ত্রিসভা গড়েন। কিন্তু গুজরাতে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মোদী নিজেই প্রশাসনিক সংস্কার, স্বরাষ্ট্র, শিল্প, বন্দর, তথ্য ও সম্প্রচার, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির মতো দফতর নিজের হাতে রেখেছেন। তাঁর ঘনিষ্ঠ নেত্রী আনন্দিবেনের হাতে রাজস্ব, খরা ত্রাণ, জমি সংস্কার, সড়ক, নগরোন্নয়ন, পুনর্বাসনের মতো দফতর রয়েছে। নিতিন পটেল সামলান অর্থ, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা শিক্ষা, পরিবার কল্যাণ ও পরিবহণের মতো দফতর। এক এক জনের হাতে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রক দিয়েই চনমনে গুজরাত গড়ার কাজ চালিয়ে এসেছেন তিনি।

বিজেপি নেতাদের মতে, সরকার চালানোর ব্যাপারে মোদীর মূল মন্ত্র হল, নীতি রূপায়ণ করে দেওয়া। এক বার নীতিটা স্থির করে দেওয়া। সেটা হয়ে গেলে সেই মোতাবেক আপনা-আপনিই সরকারের রথের চাকা এগোবে। বহু দিনের বস্তাপচা কিছু ভাবনারও বদল করতে চাইছেন মোদী। মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের নামটি বদলে সেটি শুধুই শিক্ষা মন্ত্রক করা হতে পারে। সেই মন্ত্রকের দায়িত্বে কোনও রাজনীতিক নন, কোনও শিক্ষাবিদ বা বিশেষজ্ঞকে আনতে পারেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন