ছেলের খবর মেলেনি, নাতিদের দেশে আনতে চান মুক্তেশের বাবা

সাত বছরের মিরাভ নিজের মনে বিড়বিড় করে যাচ্ছে। “প্লেন নিয়ে জলের উপরে কোথাও নেমেছে বাবা-মা। এক দিন ঠিক সাঁতরে ফিরে আসবে।” কল্পনার জগতের সঙ্গে বাস্তবটাকে অনেকটা এই ভাবেই মিশিয়ে নিয়েছে সে। দু’বছরের মাইলস তো এটুকুও বোঝে না। সে শুধু বুঝতে পারে, আশেপাশে বাবা-মা নেই। মাঝে-মধ্যে শুধু ‘মা’ বলে কেঁদে ওঠে।

Advertisement

সুনন্দ ঘোষ

কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ মার্চ ২০১৪ ০২:৩৬
Share:

বাবা-মায়ের সঙ্গে মিরাভ এবং মাইলস। ছবি: ফেসবুকের সৌজন্যে।

সাত বছরের মিরাভ নিজের মনে বিড়বিড় করে যাচ্ছে।

Advertisement

“প্লেন নিয়ে জলের উপরে কোথাও নেমেছে বাবা-মা। এক দিন ঠিক সাঁতরে ফিরে আসবে।” কল্পনার জগতের সঙ্গে বাস্তবটাকে অনেকটা এই ভাবেই মিশিয়ে নিয়েছে সে।

দু’বছরের মাইলস তো এটুকুও বোঝে না। সে শুধু বুঝতে পারে, আশেপাশে বাবা-মা নেই। মাঝে-মধ্যে শুধু ‘মা’ বলে কেঁদে ওঠে।

Advertisement

মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের এমএইচ ৩৭০ নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার পর থেকে মিরাভ-মাইলসের জীবনটা এ রকমই দিশাহীন হয়ে গিয়েছে।

এমএইচ ৩৭০ বিমানের যাত্রীদের মধ্যে মাত্র এক জনই বাঙালি ছিলেন। তিনি মুক্তেশ মুখোপাধ্যায়। সঙ্গে ছিলেন তাঁর চিনা স্ত্রী জিয়াওমো বাই। মিরাভ আর মাইলস ওঁদেরই দুই ছেলে। তাদের পাশে থাকতে বেজিং-এ জিয়াওমো’র বাবা-মায়ের কাছে জড়ো হয়েছেন মুক্তেশের বাবা-মা মলয় ও উমা মুখোপাধ্যায়। সবাই মিলে আগলে রাখছেন শিশু দু’টিকে।

মিরাভ আর মাইলস এটা বুঝতে পারছে যে, বড়সড় একটা কিছু ঘটেছে। গত বেশ কিছু দিন ধরে বাবা-মাকে দেখা যাচ্ছে না। তার বদলে দাদু-দিদার হাত ধরে সাঁতার, টেনিস খেলতে যাওয়া, ড্রাম বাজানোর ক্লাস, বেড়াতে যাওয়া সবই যেন বেশ একটু বেড়ে গিয়েছে জীবনে।

কিন্তু এ ভাবে আর কত দিন? অনন্ত এই প্রতীক্ষার শেষ কবে? উত্তরটা জানেন না কেউই। কিন্তু মিরাভ ও মাইলসকে এ বার ভারতে নিয়ে আসতে চাইছে মুখোপাধ্যায় পরিবার।

গত ৮ মার্চ হারিয়ে গিয়েছে মালয়েশিয়ান বিমান এমএইচ ৩৭০। তার দু’দিন পরই বেজিংয়ে চলে যান মুক্তেশের বাবা-মা। কলকাতা থেকে পৌঁছে যান মুক্তেশের কাকা কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী মিলন মুখোপাধ্যায়। মুক্তেশের বাবা-মা এখনও বেজিংয়েই রয়েছেন। মিলনবাবু সোমবার মুম্বইয়ে ফিরেছেন। এ দিন মুম্বই থেকেই টেলিফোনে তিনি জানান, মিরাভ-মাইলসকে ভারতে নিয়ে আসার কথা ভাবছেন তাঁরা।

তবে বিষয়টাতে বেশ কিছু আইনি জটিলতাও রয়েছে। কারণ, মিলনবাবুই জানালেন, মুক্তেশ ও তাঁর স্ত্রী কানাডার নাগরিক। কিন্তু পরে বেশ কয়েক বছর ধরে তাঁরা আমেরিকার শিকাগোয় থাকছিলেন। দুই ছেলের জন্মও শিকাগোয়। ফলে তারা আমেরিকার বাসিন্দা হিসেবে নথিভুক্ত। এই অবস্থায় তিন বছরের ওয়ার্কিং ভিসা নিয়ে সপরিবার বেজিং এসেছিলেন মুক্তেশ। সেই ভিসার মেয়াদ সেপ্টেম্বর মাসে শেষ হওয়ার কথা। তার মধ্যে যদি মুক্তেশরা ফিরে না আসেন, তা হলে স্বাভাবিক ভাবেই শিশু দু’টি কোথায় কী ভাবে থাকবে, তা নিয়ে আইনি সমস্যা দেখা দেবে। ওরা এখন বেজিংয়ে মুক্তেশের শ্বশুরবাড়িতে রয়েছে। এমতাবস্থায়, হয় জিয়াওমো-র বাবা-মাকে আবেদন করতে হবে নাতিদের নিজের কাছে রাখার জন্য। নয়, মুক্তেশের পরিবারকে আবেদন করতে হবে ওদের কাছে পাওয়ার জন্য।

সোমবার মুম্বই পৌঁছে মঙ্গলবার সারা দিন এই সব আইনি জটিলতা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেছেন মিলনবাবু। মুক্তেশের বাবা মলয়বাবু-সহ পরিবারের সকলেই চাইছেন, মুক্তেশের ছেলেরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভারতেই চলে আসুক। মিলনবাবু এ দিন বলেন, “মুম্বইয়ের পরিবার-কল্যাণ আদালতে আমরা আবেদন করব। বলা হবে, ওদের বাবা যেহেতু জন্মসূত্রে ভারতীয়, তাই ওদের ভারতে থাকার অনুমতি দেওয়া হোক। দাদা-বৌদি (মলয়বাবু এবং উমাদেবী) ওদের অভিভাবকত্বের দাবি জানাবে।”

মিলনবাবুরা চেষ্টা করছেন, ভিসা শেষ হওয়া অবধি অপেক্ষা না করে আগামী মাসের গোড়াতেই মিরাভদের ভারতে নিয়ে আসতে। জিয়াওমো-র বাবা-মাও সে সময় কিছু দিনের জন্য আসতে পারেন। মিলনবাবু জানালেন, এ সবের জন্য যাবতীয় আইনি প্রক্রিয়া দ্রুত সারতে দু’-এক দিনের মধ্যেই দেশে ফিরছেন মলয়বাবুরা।

এ ক’দিন বেজিংয়ে বসে রোজ খবরের কাগজ পড়া ছাড়া কিছুই করার ছিল না। মিলনবাবুর কথায়, “মালয়েশিয়ান বিমানসংস্থার তরফে দাদা-বৌদি ও আমাকে কুয়ালালামপুর নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেখানে গিয়ে আমরা কী করতাম?” তার বদলে ওঁরা বেজিংয়ে মিরাভ-মাইলসের সঙ্গে থাকাই মনস্থ করেন। জিয়াওমো-র বাব-মাও একই রকম উদ্বেগ আর দুশ্চিন্তা নিয়েই রয়েছেন। কোনও খবর আসার জন্য অসহায় ভাবে অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় কী? মালয়েশিয়ার তরফে আলাদা করে কোনও সাহায্যের ব্যবস্থাও চোখে পড়েনি। মিলনবাবুর কথায়, “সাহায্য পেয়েছি শুধু ভারতীয় দূতাবাস থেকে। ওরা নিয়মিত আমাদের খোঁজ-খবর নিয়েছে। মুক্তেশের অফিসও খুব সাহায্য করেছে।”

কিন্তু সংশয় আর অনিশ্চয়তার মানসিক চাপ কি আর এতে কমে? ছোট্ট মিরাভ এখনও বিশ্বাস করে, “পাপা-আম্মি ফিরে আসবে।” সত্যি কি ফিরবেন মুক্তেশরা? মিলনবাবু শুধু বললেন, “যদি জেনে যেতাম বিমান ভেঙে পড়েছে, এক রকম ছিল। কিন্তু এই অনিশ্চিত অপেক্ষা নিয়ে কাটানোর যন্ত্রণা বলে বোঝানো সম্ভব নয়।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
আরও পড়ুন