জঙ্গিদের ভয়ে বাসে উঠেই মৃত্যু ভোটকর্মীদের

ভোট বয়কটের আহ্বান জানিয়ে এলাকায় পোস্টার পড়েছিল। এমনকী, দিনের আলোয় ঘুরে ঘুরে মাইকে তা প্রচারও করেছিল মাওবাদীরা। হুঁশিয়ারি না-মানলে ফল যে কতটা মারাত্মক হতে পারে, তার প্রমাণ দিতেই গত কাল ল্যান্ডমাইনে পুলিশ, ভোটকর্মীদের বাস উড়িয়ে দেয় জঙ্গিরা। আহতদের দিকে চলে গুলিবৃষ্টিও। এমনই জানালেন দুমকার শিকারিপাড়ার কয়েক জন গ্রামবাসী। মাওবাদী নৃশংসতার ছবিটা ভেসে উঠল তাঁদের কথাতেই।

Advertisement

ভাস্করজ্যোতি মজুমদার ও প্রবাল গঙ্গোপাধ্যায়

শিকারিপাড়া ও রাঁচি শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:২৮
Share:

মাইনে ক্ষতিগ্রস্ত বাস ঘিরে জওয়ানরা। ছবি: তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়।

ভোট বয়কটের আহ্বান জানিয়ে এলাকায় পোস্টার পড়েছিল। এমনকী, দিনের আলোয় ঘুরে ঘুরে মাইকে তা প্রচারও করেছিল মাওবাদীরা। হুঁশিয়ারি না-মানলে ফল যে কতটা মারাত্মক হতে পারে, তার প্রমাণ দিতেই গত কাল ল্যান্ডমাইনে পুলিশ, ভোটকর্মীদের বাস উড়িয়ে দেয় জঙ্গিরা। আহতদের দিকে চলে গুলিবৃষ্টিও। এমনই জানালেন দুমকার শিকারিপাড়ার কয়েক জন গ্রামবাসী। মাওবাদী নৃশংসতার ছবিটা ভেসে উঠল তাঁদের কথাতেই।

Advertisement

ভোটে রক্তপাত রুখতে কয়েকটি পরিকল্পনা করেছিল কমিশন, রাজ্য প্রশাসন। জঙ্গি-অধ্যুষিত এলাকার নির্দিষ্ট জায়গা পর্যন্ত (ক্লাস্টার) হেলিকপ্টারে ভোটকর্মীদের পৌঁছে দেওয়া হচ্ছিল। কেন্দ্রীয় বাহিনীর পরামর্শ অনুযায়ী, সেখান থেকে নিরাপত্তা বাহিনীর পাহারায় হেঁটে বুথে পৌঁছতেন তাঁরা। ভোট মিটলে তাঁদের কপ্টার পর্যন্ত হেঁটেই ফিরতে বলা হয়েছিল।

জঙ্গিদের ভয়ে অন্ধকার হওয়ার আগেই নিরাপদ জায়গায় ফিরতে চেয়েছিলেন ভোটকর্মীরা। পুলিশ তাঁদের বাসে উঠতে বলায় আর কিছু ভেবে দেখেননি। পুলিশকর্তারা বলছেন, রণকৌশলের সেই ভুলেই এত গুলি প্রাণ নষ্ট হল।

Advertisement

বীরভূমের মহম্মদবাজার থানার শেষ প্রান্ত মুরালপুরের মকদাপাড়া। তার পর খরস্রোতা দ্বারকা নদী। ও-পারে ঝাড়খণ্ডের শিকারিপাড়া থানার বাঁকিজোড়, সরসা গ্রাম।

সরসা এবং পলাসি গ্রামের মধ্যে একটি ছোট সেতুর নীচেই ল্যান্ডমাইন রেখেছিল জঙ্গিরা। ভোট পর্ব মিটিয়ে ছোট লরি, বেসরকারি বাসে ফিরছিলেন পুলিশ, ভোটকর্মীরা।

স্থানীয় এক গ্রামবাসী বললেন, “তখন বিকেল সাড়ে চারটে। হঠাৎ বিকট আওয়াজ। গুলির শব্দ। গাছের আড়াল থেকে দেখলাম, ২০-২৫ জন লোক গাড়িগুলোর দিকে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি ছুড়ছে। ৩-৪ জন পুলিশও গুলি করছিলেন। ঘন্টা খানেক পর ওই পুলিশকর্মীরা পালানোর চেষ্টা করলে, তাঁদের ঘিরে ধরে গুলি করে মারে জঙ্গিরা।” প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, পরে অন্য জায়গা থেকে অনেক জওয়ান পৌঁছন। দু’পক্ষে সংঘর্ষ চলে। গুলি ছুড়তে ছুড়তে মাওবাদীরা কল্যাণপুরের দিকে চলে যায়।

গ্রামবাসীদের দাবি, এক সপ্তাহ আগে আসনবুনির মিশন, সরসা, রাজবান্ধ-সহ কয়েকটি জায়গায় মাওবাদীরা পোস্টার দিয়েছিল। তাতে লাল কালিতে লেখা ছিল ‘কেউ ভোট দেবেন না। ভোট দিলে বিপদ আছে। ভোট বয়কট করুন।’ গত শনিবার বিকেলে সরসা হাটে ২০-২৫ জন তরুণী মাইকে ভোট-বিরোধী প্রচার করে যায়।

কারাকাটা পাহাড়ের কিছুটা দূর দিয়ে গিয়েছে সরসা-শিকারিপাড়ার রাস্তা। যেখানে বিস্ফোরণ হয়েছে, তার চারদিকেই ভগবানপুর জঙ্গল। এলাকার বাসিন্দারা জানান, সেতুর নীচ দিয়ে ল্যান্ডমাইনের তার ১৮-২০ মিটার দূরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানে অপেক্ষায় ছিল মাওবাদীরা।

পলাসি পঞ্চায়েতের আসনা ও জামকাদা বুথের ভোটকর্মী এবং নিরাপত্তায় মোতায়েন পুলিশদের নিয়ে শিকারিপাড়া ফিরছিল বাসটি। মাঝপথেই বিস্ফোরণ।

আজ সকালে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, বাসের ছাদ উড়ে গিয়েছে। ভিতরটা লন্ডভন্ড। চাকাগুলোর লোহার কাঠামোও দুমড়ে গিয়েছে। পাশেই ছোট মাঠ। তার কাছে একটা মহুয়া গাছ। পুলিশের অনুমান, ওই গাছের নীচেই ডিটোনেটর নিয়ে বসেছিল মাওবাদীরা। বাসের ধ্বংসস্তূপের আশপাশে ছড়িয়ে টুথপেস্ট, টিফিন-বাক্স, রক্তমাখা জুতো। মাটিতে মিশে রয়েছে পোড়া চামড়া, চুল, রক্ত, মাথার ঘিলু। পড়েছিল ভোটের কয়েকটা কাগজও।

ভোট-নিরাপত্তার সাঁজোয়া-বাহিনীর নজরদারির মধ্যেও কী ভাবে কাজ হাসিল করল মাওবাদীরা?

জবাবে নিজেদেরই ভুল মেনে নিলেন ঝাড়খণ্ডের উচ্চপদস্থ পুলিশ-কর্তারা। ডিজি, আইজি (অপারেশন) মানলেন জঙ্গি-অধ্যুষিত এলাকায় গাড়িতে ফেরার সিদ্ধান্তটাই ভুল ছিল। ভোটকর্মীদের বাসে উঠতে বলেছিলেন পুলিশকর্মীরাই। সেই ভুলেরই মাসুল গুনতে হল সকলকে।

এ দিন শিকারপাড়ায় গিয়েছিলেন ডিজি রাজীব কুমার। সঙ্গে ছিলেন আইজি (অপারেশন) এল এম মিনাও। ডিজি জানান, প্রাথমিক তদন্তে জানা গিয়েছে, বীরভূমে সক্রিয় মাওবাদীদের একটি দল ঘটনাটি ঘটিয়েছে। পরিকল্পনা করেছে জঙ্গিদের আঞ্চলিক কম্যান্ডার হীরেন্দ্র মুর্মূ ওরফে প্রদীপদা। দুমকা, লিট্টিপাড়া, বরহেটের পাশাপাশি বীরভূমের খয়রাশোল, ভীমগড়ে হীরেন্দ্রর দলই এখন সক্রিয়। ডিজি জানিয়েছেন, ওই সব এলাকা থেকে মাওবাদীদের উৎখাত করতে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের সঙ্গে ঝাড়খণ্ড যৌথ অভিযান চালাবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন