গোলাপের কাঁটায় হাত রক্তাক্ত হওয়ার ভয় তিনি পাচ্ছেন না! বরং, দেশের একমাত্র বাম-শাসিত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী জানাচ্ছেন, তাঁদেরই ডেকে-আনা তদন্তের জাল গোটাতে তাঁর সরকার সব রকম সাহায্য করবে। দলের তরফেও কাউকে আড়াল করার কিছু নেই। হারানো আমানত ফেরাতে সরকারি সাহায্যেরও ভাবনা নেই!
বেসরকারি লগ্নি সংস্থা রোজ ভ্যালির কারবার নিয়ে তদন্তের কাজে ত্রিপুরায় হানা দিয়েছে সিবিআই। সংস্থার বহু দফতরে তল্লাশি হয়েছে, জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে পাঁচ কর্তাকে। সিবিআই হানার সঙ্গে সঙ্গেই রোজ ভ্যালির সঙ্গে সে রাজ্যের শাসক দল সিপিএমের যোগসাজশের অভিযোগ উঠেছে। রোজ ভ্যালিতে আস্থা বাড়াতে তিনি প্রকাশ্যেই আবেদন জানান বলে মেনে নিয়ে ‘অস্বস্তি’ বাড়িয়েছেন ত্রিপুরার বাম সরকারের মন্ত্রী বিজিতা নাথ। ত্রিপুরায় বিরোধীরা তো বটেই, পশ্চিমবঙ্গেও বিজেপি এবং অন্যেরা বলছে, তৃণমূলের যদি সারদা থাকে, তা হলে সিপিএমের রোজ ভ্যালি! খোঁচা দিতে ছাড়ছে না তৃণমূলও!
নানা রকম জল্পনায় দাঁড়িয়ে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন মানিক সরকার। তাঁর সাফ কথা, “তদন্ত হচ্ছে, খুব ভাল কথা! আমাদের সরকারের চিঠিরতেই ত্রিপুরায় সিবিআই গিয়েছে। আড়াল করার কিছু নেই। থাকলে কি রোজ ভ্যালি নিয়ে চিঠি দিতাম?” দলের এই পলিটব্যুরো সদস্য আরও জানাচ্ছেন, সারদা-কাণ্ডে তৃণমূল আর রোজ ভ্যালিতে বামেদের গুলিয়ে ফেলা উচিত হবে না। রোজ ভ্যালির কাছ থেকে আর্থিক বা অন্য সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ তাঁদের দলের কারও বিরুদ্ধে নেই বলেই মানিকবাবুর দাবি। তবু তদন্তের প্রয়োজনে ডাক পেলে অবশ্যই সিবিআইয়ের মুখোমুখি হবেন। সরকারি সূত্রের খবর, সিবিআই অভিযানের খবর পাওয়ার পরেই ত্রিপুরা পুলিশের ডিজি-কে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার যে কোনও প্রয়োজনে পুলিশ যেন প্রস্তুত থাকে। প্রথম দিন খানা-তল্লাশির সময় মহিলা পুলিশের সাহায্য চেয়েছিল সিবিআই। রাজ্যের তরফে তার ব্যবস্থাও করা হয়েছিল। সরকারি সূত্রে বলা হচ্ছে, সিবিআই তদন্ত চাই বলে কেন্দ্রের কাছে দাবি জানানোর পরে এখন তদন্তের সময় কেন্দ্রীয় সংস্থাকে সাহায্য করাই স্বাভাবিক।
সিবিআইকে দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে ‘চক্রান্ত’ করা হচ্ছে, এই মর্মে বাংলার তৃণমূলের মতো মিছিল-সমাবেশ-ধর্না ত্রিপুরার সিপিএম করেনি ঠিকই। করার পরিকল্পনাও নেই। কিন্তু রাজ্যেরই এক মন্ত্রীর মন্তব্য কি জল্পনা উস্কে দিচ্ছে না? ওই মন্ত্রী রোজ ভ্যালির আস্থা বাড়ানোর কথা বলেছিলেন একটি হাসপাতালের শিলান্যাস অনুষ্ঠানে। মুখ্যমন্ত্রীর যুক্তি, কোনও বেসরকারি সংস্থা হাসপাতাল বা হোটেলের মতো ব্যবসা করতে চাইলে রাজ্য সরকারের কী করার আছে? রোজ ভ্যালি আগরতলার বাইরে ত্রিপুরার উদয়পুরে বড় হোটেল গড়ে তুলছিল। সরকারি সূত্রের বক্তব্য, আগরতলায় শিশুদের জন্য ওই সংস্থার নির্মিত একটি পার্কের উদ্বোধনে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীও গিয়েছিলেন। সরকারি তরফে বলা হচ্ছে, ছোটদের জন্য পার্কে অসুবিধার কী আছে? পার্ক, হাসপাতাল বা হোটেলের পাশে দাঁড়ানো মানে কি ‘চিট ফান্ড’কে সাহায্য করা হল?
সারদা-কাণ্ড প্রকাশ্যে আসার পরে আমানতকারীদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য সরকারি টাকায় তহবিল খুলেছিলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তৃণমূলের সঙ্গে তাঁদের ফারাক স্পষ্ট করে দিয়ে মানিকবাবু জানাচ্ছেন, তাঁরা এমন পথে হাঁটবেন না। মানিকবাবুর কথায়, “রোজ ভ্যালি বাজার থেকে কী টাকা তুলেছে, তার দায় আমাদের সরকার নিতে যাবে কেন? করপ্রদানকারী সাধারণ মানুষের টাকায় এমন তহবিল খোলার কোনও প্রশ্নই নেই! সেটা করলে অন্যায়টারই পাশে দাঁড়ানো হয়! যারা মানুষের টাকা ফেরত দিতে পারছে না, তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে বিক্রি করে অর্থ ফেরতের যা প্রক্রিয়া আছে, তা-ই করতে হবে।” রাজ্য অর্থ দফতরের অধীনে ডিরেক্টরেট অফ স্মল সেভিংস, গ্রুপ ইনসিওর্যান্স অ্যান্ড ইনস্টিটিইউশনাল ফিনান্স-এর করা সমীক্ষা অনুযায়ী রোজ ভ্যালি ত্রিপুরায় আমানত সংগ্রহ করেছিল ৭৬৭ কোটি ৬১ লক্ষ টাকার। তার মধ্যে ৬৪২ কোটি ৬১ লক্ষ টাকাই তারা আমানতকারীদের ফেরত দিয়েছে। সেই দিক থেকে আমানতকারীদের বকেয়া টাকা ১২৫ কোটি।
ত্রিপুরায় সারদার কাজকর্ম তেমন ভাবে কোনও দিনই বিস্তৃত ছিল না। বরং সেখানে যে রোজ ভ্যালি অনেক বেশি জাল ছড়িয়েছে, জানতেন মানিকবাবুরা। বিপুল হারে সুদ-সমেত টাকা ফেরত পাওয়ার আশায় আমানত করে মানুষ কিছু পাচ্ছেন না, জানতে পারার পরে রাজ্যের অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর আলোচনায় ঠিক হয় এই কারবার বন্ধ করতে কেন্দ্রের দ্বারস্থ হতে হবে। সেইমতোই দিল্লিতে চিঠি পাঠানো হয় সিবিআই তদন্ত চেয়ে। ত্রিপুরা সিপিএমের এক রাজ্য নেতার কথায়, “নানা প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে চাই, এমন আর্জি নিয়ে অনেক ব্যবসায়ীই সরকারের কাছে আসেন। রোজ ভ্যালির কর্ণধার গৌতম কুণ্ডুও মুখ্যমন্ত্রীর সাক্ষাৎপ্রার্থী হয়েছিলেন। তাই বলে সেবি-র নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে ওঁদের সংস্থার বিজ্ঞাপন কিন্তু রাজ্যে দলীয় মুখপত্রে ছাপা হয়নি।”
একমাত্র বাম-শাসিত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর নিজস্ব ভাবমূর্তি এখনও নিষ্কলুষ। রাজ্যে বিরোধীদের কেউ কেউ অবশ্য বলতে শুরু করেছেন, মুখ্যমন্ত্রীর কাছেও এটা-সেটা উপঢৌকন দিয়েছে এই সব লগ্নিসংস্থার কারবারিরা! মানিকবাবু হেসে বলছেন, “কেউ কেউ এ সব বলে আনন্দ পান! মিথ্যা দিয়ে কি জয় করা যায়?”